Alor Sandhane - আলোর সন্ধানে
ভক্ত ও ভক্তি :
ভারতবর্ষ বহু প্রাচীনকাল হতেই ধর্মভিত্তিক একটি দেশ হিসেবে পরিচিত এবং এদেশকে আধ্যাত্মিকতার পীঠস্থানও বলা হয় । মন্দির, মসজিদ, গির্জা ইত্যাদি কোনোটার-ই অভাব এখানে নেই এবং উত্তরোত্তর সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েই চলেছে ! প্রতিবৎসর কত টাকা যে ইনভেষ্ট হয় এসবের জন্য তার সঠিক হিসেব নেই । তবে এগুলি যে দানের টাকা তা নিঃসন্দেহে বলা যায় ! এই দান দেয় কারা ? অবশ্যই ভক্ত যারা ! এই টাকা কিভাবে বা কারা ভোগ করেন সেটা সহজেই অনুমেয় । তবে ভারতবর্ষে যে ভকতসুজনদের কোন অভাব নেই একথা স্বীকার করতেই হবে ! এদের মধ্যে আবার অনেকে প্রতিষ্ঠিত নামী মানুষ আছেন যারা অনেকের চোখে মহান ব্যক্তিত্ত্ব ! যে দেশে ভক্তের অভাব নেই, সেখানে এত সামাজিক অনাচার ও দুর্নীতি কেন ? কিসের অভাব ??
এরই উত্তর দিয়েছেন এবং দিশা দেখিয়েছেন হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরের পরম ভক্ত ‘সাধক’ অশ্বিনী সরকার । তিনি একটি গানে বলেছেন -------
“ভক্তি কে যে তুচ্ছ করে মুক্তি ক’রে শ্রেষ্ঠ ।
হরি নামে পাপ খন্ডে ব্যাখ্যা ক’রে সেই দুষ্ট ।।”
আমরা বেশীর ভাগ মানুষই বাস্তবতা ভুলে নানারকম অলৌকিকতা ও বাহ্যিক উপাচার নিয়েই মত্ত । বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে সর্বক্ষণ যার উপস্থিতি সেই পরম দয়াল ‘পরমেশ্বর’কে আমরা চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী বানিয়ে ফেলেছি ! তাই মানুষকে ভাল না বেসে ভালবাসছি নানারকম কাল্পনিক মাটি বা পাথরের মূর্তিকে এবং মুক্ত হস্তে দান করছি ! নিজে পূজা না করে, এক ফোঁটা চোখের জল না ফেলে টাকার বিনিময়ে অন্যকে দিয়ে পূজা করাচ্ছি । ‘পরম দয়াল’ শুধু চান নিঃস্বার্থ ভালবাসা ও ভক্তি, তাঁরই সন্তানদের অর্থাৎ সমস্ত জীব জগতকে ভালবাসার মধ্যে দিয়ে । যেখানে টাকা-পয়সা, ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্রের কোনও ব্যাপার নেই । অর্থাৎ যেখানে ভক্তি নেই, সেখানে মুক্তি অসম্ভব। ভারতবর্ষে ভক্তের অভাব নেই, শুধু ভক্তি নেই । তাই এই দুর্দশা । এখানে প্রশ্ন আসে, তাহলে ভক্তি কি ? ভক্তি কি কোন যুক্তি তর্কের ধার ধারে না ; নাকি অহেতুক চোখে জল দেখানোই ভক্তির নমুনা ? তাই ‘ভক্তি’ বিষয়টি আমাদের কাছে পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন । “শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত” গ্রন্থে আছে------
“কর্মেতে প্রধান হবে ধর্মেতে প্রবল ।
বাহুতে রাখিবে শক্তি চক্ষে প্রেম-জল ।।”
এই ‘প্রেম-জল’ই হল ভক্তি------যার ব’লে কেতাবী শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও অশ্বিনী গোঁসাই “শ্রীশ্রীহরি সঙ্গীত” নামক অমূল্য সম্পদ আমাদের দিয়ে গেছেন । ‘কবিরসরাজ’ তারক সরকার “শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত” রচনা করেছেন । গোপাল সাধু যার গুণে সুবিশাল কর্মকান্ড আমাদের দেখিয়ে গেছেন । যার কারণে গুরুচাঁদ ঠাকুর এবং মতুয়া ভক্তদের দ্বারা হাজার হাজার স্কুল তৈরী হয়েছে এবং হচ্ছে। এরকম উদাহরন যে কত আছে তা লিখে শেষ করা যায় না।
সুতরাং মতুয়ার ভক্তি জড়বাদী নয় । তাঁদের ‘ভক্তি’ জ্ঞান মিশ্রিত ভালবাসায়-------সমস্ত জীব প্রেমের মাধ্যমে, আত্মোন্নতির মাধ্যমে, মানুষ হওয়া ও মানুষ করার মাধ্যমে । তাই দেখা যায়, মতুয়ার ভক্তি শিক্ষায় অর্থাৎ জ্ঞানার্জনে, আত্মধর্ম রক্ষায়, গৃহধর্ম রক্ষায় এবং প্রতিটি কাজে-কর্মে ।
গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছিলেন শুধু ঐশ্বর্য নয়, মাধুর্য্যেরও অধিকারী হতে হবে, তবেই হবে আমার বাবার প্রকৃত ভক্ত । এই ‘মাধুর্য্য’ই হল ভক্তি । তাই দেখা যায় আজকের দিনে যারা প্রকৃত মতুয়া হতে পেরেছেন তাঁরা ঐশ্বর্য্যবান হয়েও অন্তরে রাখেন প্রেমের বারিধারা ।মতুয়ারা ভক্তি মানে শুধু কান্নাকাটি বা ঢলাঢলি বোঝেন না । মতুয়াদের কান্না থাকে অন্তরে । তাই গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছেন ------
“কান্দাকান্দি নাহি চাই কাজ-ছাড়া কান্দা ছাই
‘অকেজো কান্দুনে’ সব নাম ।
কান্দাকান্দি ঢলাঢলি কতকাল করে এলি
কি’বা ফল পেলি তা’তে বল ?
কর্ম ছেড়ে কান্দে যেই, তার ভাগ্যে মুক্তি নেই
হ’বি নাকি বৈরাগীর দল ?
সে যুগ গিয়াছে চলে, আমি বাপু যার ছেলে
তার ধর্মে জন্মে মহাবীর ।।”
আরও বলছেন-------
“কান্না শুধু নয় চোখে কান্না যার থাকে বুকে
মুখে তার কথা নাহি ফুটে ।।”
মতুয়াধর্মমত কখনই সনাতনধর্ম নয়------এটি স্বাধীন, সতন্ত্র ‘সূক্ষ্ম’ একটি ধর্মমত ; যেখানে মানুষই ইষ্ট-নিষ্ঠ । মনুষ্যত্ববোধ বজায় ও জৈবিক জীবন সংগ্রামে সাফল্যের প্রতিটি স্তরের শিক্ষাদান করা হয়েছে হাতে-কলমে । তবে ‘সূক্ষ্ম’ কথটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । এর অর্থ আমাদের সর্বাগ্রে বুঝতে হবে । গুরুচাঁদ ঠাকুর বলতেন------“ছেলে-মেয়ে দেবে শিক্ষা, দরকার হলে করবে ভিক্ষা”; আবার তিনিই বলেছেন------“ভিক্ষা করা মহাপাপ” । দুটি কথা আপাত দৃষ্টিতে বিপরীত শোনালেও এখানে যে সূক্ষ্ম যুক্তিটি রয়েছে তা আমাদের বুঝতে হবে । তিনি এও বলেছেন-------
“বিশ্ব ভরে’ এই নীতি দেখি পরস্পর।
যে যা’রে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর ।।”
অর্থাৎ এখানে ভীষন পরিস্কার যে, ঈশ্বর বলতে ‘পরিত্রাতা’কেই বোঝানো হয়েছে । সুতরাং, মতুয়ার ভক্তি ‘জড়বাদী’ নয় । মতুয়ার বিশ্বাস আছে, ভক্তি আছে কিন্তু কোন অলৌকিকতা, কাল্পনিক জগৎ এমনকি কাল্পনিক শান্তির বানী’র-ও স্থান নেই । মতুয়ারা শান্তির জগৎ তৈরী করে। সুতরাং পূর্ণব্রহ্ম, অবতার, মহাপুরুষ, মহামানব সবকিছুই তাঁদের কাছে ঠাকুর হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ।
(চলবে)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন