আলোর দিশারীঃ শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর
প্রথম পর্ব
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষে এক ঘোর তমসাময় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল । ধর্মের নামে শোষণ, বঞ্চনা ও অরাজকতায় ভরে গিয়েছিল দেশ । বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ দলে দলে ইসলাম বা খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেছিল। দেখা দিয়েছিল এক মহা যুগ-সংকট । এমতাবস্থায় মানব মুক্তির উদাত্ত আহ্বান নিয়ে ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দের ১১ই মার্চ বুধবার পূর্ববঙ্গের (বর্তমানে বাংলাদেশ) ফরিদপুর জেলার সফলাডাঙ্গা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন মহামানব হরিচাঁদ ঠাকুর । পিতা যশোবন্ত ঠাকুর ও মাতা অন্নপূর্ণাদেবী । পরবর্তী সময়ে জমিদার সূর্যমনি মজুমদারের অত্যাচারের কারণে সফলাডাঙ্গা ত্যাগ করে ওড়াকান্দী গ্রামে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন । শুরু হয় এক নূতন দিগন্ত । হরিচাঁদ ঠাকুর সমস্ত ভন্ডামী ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন বালক বয়স হতেই । তিনি লক্ষ করেছিলেন কিভাবে মানুষ ধর্মের কারণে ব্যভিচারে লিপ্ত হচ্ছে । আত্মমর্যাদাবোধ হারিয়ে কিভাবে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে । এসব লক্ষ করেই তিনি এর প্রতিবিধানের জন্য নিরলস সংগ্রাম করেছেন আজীবন । ঠাকুর এসেছিলেন সুবিচারের ন্যায়দন্ড হাতে নিয়ে । সাকার, নিরাকার, বৈষ্ণবধর্ম, শাক্তধর্ম, ইসলামধর্ম, খ্রীষ্টানধর্ম যেখানে যত ধর্ম আছে, সর্বধর্মের নির্যাসে হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর জীবনচর্চায় শাশ্বত যে মূলবস্তুটি বিশ্বমানবকে উপহার দিলেন তা হল “মানবধর্ম” । আজ’কে আমাদের মান, গর্ব, অধিকার, বাক্ স্বাধীনতা সবই এসেছে মানব মুক্তির মহান দুই পুরুষ হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের হাত ধরে । বাংলার বাইরেও যার ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল ধীরে ধীরে । তাঁদের কর্ম জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হল ।
১) মানবাধিকার রক্ষায় সংগঠনঃ ঠাকুর হরিচাঁদ সর্বপ্রথম মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে নামলেন । কারণ তিনি জানতেন দীর্ঘকাল যাবৎ ‘পিছিয়ে রাখা’ জাতির উন্নতি আত্মশক্তি’র উত্থান এবং সংঘবদ্ধ শক্তি ছাড়া সম্ভব হবে না । তাই তিনি সর্বপ্রথম কয়েক’শ বৎসর যাবৎ সমস্ত অধিকার বঞ্চিত মানুষদের ঐক্যবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন । যেখানে সাহা, নমঃশূদ্র, কূম্ভকার, কুন্ডু, কায়স্থ্য, মুসলীম, ব্রাহ্মণ, তেলী, মালী প্রভূতি ৩৬-টি সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের অধিকার ও আত্মমর্যাদাবোধ খুঁজে পেয়েছিলেন । তৎকালীন আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থায় দাঁড়িয়ে এ-কাজ যে কতখানি দূরহ ও কঠিন তা এসময়ে আমরা কল্পনাও করতে পারি না । তিনি ঘোষনা করলেন মানুষে মানুষে কোন ভেদ নেই, সব জাতিই এক । প্রকৃতির আলো-বাতাসে যেমন সবার অধিকার আছে তেমনি সমাজ ব্যবস্থায়ও সবার সমানাধিকার থাকবে । চিরাচরিত সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চেয়ে তিনি প্রতিবাদের ধ্বনি ছড়িয়ে দিলেন দিকে দিকে । নিষ্প্রাণ মানুষগুলি ফিরে পেল প্রাণ । চারিদিকে বেজে উঠল ঊলুধ্বনি, জয়ডংকা, কাঁসর ও হরিধ্বনির মহা-কলরোল ।
“হরি বলে ডংকা মার, শংকা কর কা’রে ।
শ্রীহরি সহায় হ’য়ে সাথে সাথে ফেরে ।।” (“শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত”)
২) নারী পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠাঃ পূর্বের যে সব মহাপুরুষ বা মহামানবের পদচিহ্ন আমরা এই ভারতবর্ষের ধূলায় খুঁজে পেয়েছি তাঁরা কেউ সমাজের ‘পিছিয়ে রাখা’ পতিত মানুষের হাত ধরে টেনে তোলেননি । মনুষ্যত্ত্বের অধিকার প্রদান বা রাজনৈতিক চেতনা প্রদান করেননি । তাঁরা সংসার বা নারীকে নির্মম ও নির্দয়ভাবে উপেক্ষা করেছেন । তাঁদের মতে-----নারী সাধন পথের অন্তরায়, নারী নরকের দ্বার, নারীর প্রয়োজন শুধুমাত্র “পুত্রার্থে ক্রীয়তে ভার্য্যা” । ‘নারীর হাত ধরে পাপ প্রবেশ করে’ এই অজুহাতে তাঁদের সমস্ত রকম অধিকার হতে বঞ্চিত করা হত। এমন এক সময় ছিল বিধবা নারীর সূর্যের মুখ দেখা নিষিদ্ধ। লেখাপড়ার তো কোন প্রশ্নই ওঠে না । হাজার রকমের নিয়মের বেড়াজালে বেঁধে একটা বিধবা মেয়েকে তিলে তিলে শেষ করে দেওয়া হত । অথচ বহুবিবাহ করতে বর্ণবাদীদের কোন বাঁধা ছিল না ! যে নারী মানব জাতির সৃষ্টির কারণ, সেই নারীর উপর কত’ই না নির্যাতন ও লাঞ্ছনা !! তাই হরিচাঁদ ঠাকুর বললেন------নারীজাতি মাতৃজাতি, তাকে সম্মান দিতে হবে, মর্যাদা দিতে হবে । যে জাতি নারীর সম্মান, মর্যাদা এবং অধিকার দেয় না, সে জাতি বা দেশ কখনই উন্নতিলাভ করতে পারে না । তাই তিনি নারী জাতিকে পূর্ণ সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার দিয়ে বললেন, মেয়েরা পুরুষের সাথে একসঙ্গে নাম-সংকীর্তন করবে । ভক্ত দশরথের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে মহিলা কাছারী বসিয়ে তিনি অত্যাচারী নায়েবের বিচার করেছিলেন । নারীর প্রতি মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করাই ছিল এর মূল লক্ষ । ঊনবিংশ শতাব্দীর ইসিহাসে নারীকে এইরূপ বিচারকের আসনে আসীন করানো তৎকালীন সময়ে এক বিরল দৃষ্টান্ত এবং গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ।
৩) নীলকুঠি অভিযানঃ সাধারণ মানুষের উপর নায়েবের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রায় তিন শ’তাধিক ভক্তসহ ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে জোনাসুর ‘নীল কুঠিয়াল’ ডিক সাহেবের নীল কুঠি অভিযান করেন । সমস্ত রকমের সাহায্যের আশ্বাস দেন ডিক সাহেব ।
৪) ‘মতুয়া’ নামকরণঃ হরিচাঁদ ঠাকুর ছিলেন ন্যায় ও সত্যের জীবন্ত প্রতীক । অলীক ধর্মীয় কূপমন্ডুকতার নগ্ন প্রাচীরে তাঁর ধর্ম-কর্মের আদর্শ সীমাবদ্ধ নয় । আজগুবি সর্বনাশা সব নিয়মের বিসর্জন দিয়ে সুস্থ শরীর, শিক্ষা আর সৎচরিত্র গঠনের মাধ্যমে জৈবিক জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়া মনুষ্য জীবনের কাম্য যেখানে থাকবে মানবিকতা ও জীবে প্রেম । এর জন্য বাস্তবসম্মত, বিজ্ঞানসম্মত পথে চলতে পারলেই মিলবে সত্যের সন্ধান। এই ভাবধারা নিয়ে যারা চলেন তাঁদেরকে অপর একটি নামে হরিচাঁদ ঠাকুর ভূষিত করেছিলেন------“মতুয়া” । মতুয়া হতে গেলে কোন তথাকথিত নিয়ম বা দীক্ষার প্রয়োজন নেই । অভিন্ন মানবজাতি গঠনের প্রয়াস লক্ষিত হয়েছে তাঁর ‘মতুয়া’ উপাধিতে । জন্ম হতে মৃত্যূ অবধিই যেখানে এক ধর্মক্ষেত্র । যেখানে জাতপাত নেই, সাম্প্রদায়ীকতার বিভেদ নেই; আছে কেবল মানুষের মনে মহাশক্তি জাগ্রত হওয়ার বীজ। গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় নয়, তথাকথিত ধর্ম নয়, এ যেন এক আদর্শ সমাজবদ্ধ মানব সত্ত্বা ।
“শুধু নমঃশূদ্র নয় যারা যারা দুখী রয়
সবে মিলে এক সঙ্গে করে ধর্ম যুদ্ধ ।
তেলি মালি কুম্ভকার জোলা তাঁতী মালাকার
ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য আর নব-শাখ ।।
ব্যাথিত মুসলমান হ’ল কত আগুয়ান
হরিচাঁদে পেয়ে তারা বলে ‘মোরা এক’ ।
গৃহ ধর্ম সু-আচার পিতা দিল ঘরে ঘর ।
দলিত পতিত নর উঠিল মাতিয়া ।।
তাঁর ভাবে ভাব ধরা তাঁর প্রেমে মাতোয়ারা
“মতুয়া” উপাধি কয় সে ভাব দেখিয়া ।।” (“শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত”)
হরিচাঁদ ঠাকুরের মতাদর্শ আর মানবতাবাদ একই কথা । একটি বিষয় বিশেষ লক্ষনীয় যে, নিজেকে মতুয়া বললেই মতুয়া হওয়া যায় না------যেহেতু দীক্ষার মাধ্যমে মতুয়া সাজা যায় না । ‘আমি কী’------তা মানুষ বলবে এবং তা নির্ভর করবে আমার প্রতিক্ষণের আচরণ বা কর্মের উপর । এখানে আত্মসন্তুষ্টির কোন জায়গা নেই । ‘মতুয়া’ উপাধি সহজলোভ্য যেমন নয়, তেমনিই যেকোন ধর্মের বা বর্ণের মানুষ চরিত্র গঠন ও কর্মের মাধ্যমে ‘মতুয়া’ হতে পারেন । তাই দেখা যায়, মতুয়াদর্শের শীতল ছায়াতলে নানা-ধর্মমতের, নানা-বর্ণের মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছেন বা নিচ্ছেন । সুতরাং মতুয়া আদর্শ জাত-পাত ও দেশ-কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়-----এ আদর্শ কালজয়ী ।
৫) সংসার ও সন্ন্যাসের মধ্যে সমন্বয় স্থাপনঃ ঠাকুর হরিচাঁদ মনে করতেন দেশের মানুষই সব । মানুষ সচেতন না হলে এদেশের দূরারোগ্য ব্যাধি কোনদিন মুক্ত হবার নয় । তাই তিনি মানুষকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও রাজনৈতিক চেতনা প্রদানপূর্বক সংসার ও সন্ন্যাসের মধ্যে এক অপূর্ব সমন্বয়ের সৃষ্টি করেছেন । তাঁর বাণী নিখিল বিশ্বে ঐক্য ও সংহতির মহামিলনের এক অচিন্ত পূর্ববার্তা । তাঁর প্রচারিত শিক্ষা শুধু ধর্ম শিক্ষাই নয়, তাঁর আদর্শ সমাজ ও জাতীয়তাবোধের শিক্ষা । ঠাকুর বলতেন-----মানুষ সংসার মাঝে সংসারী হয়েই থাকবে কিন্তু যে যে কারণগুলির জন্য মানুষ সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করে সেই কারণগুলিকেই পাঠাতে হবে সন্ন্যাসে । ঠাকুর হরিচাঁদ সাধন জগতে, ভজন ও পূজন প্রণালীতে এবং উপাসনার ক্ষেত্রে সংসারকে এক ধর্ম পরীক্ষার ক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত করেন যা সন্ন্যাস গ্রহণের চাইতেও দুরন্ত কঠিন । জ্ঞান কিম্বা মোক্ষলাভের আশায় সংসার ছেড়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করে বাইরে যাবার কোনও প্রয়োজন নেই । সংসারে থেকেও মতুয়ারা সংসারে আসক্তিবিহীন এক একজন পরম সন্ন্যাসী । মতুয়ারা কোন মন্ত্র-তন্ত্র বা তীর্থ ভ্রমনে বিশ্বাসী নয় ।
“গৃহেতে থাকিয়া যার হয় ভাবোদয় ।
সেই সে পরম সাধু জানিবে নিশ্চয় ।।”
অথবা,
“দেহের ইন্দ্রিয় বশ করেছে যে জন ।
তার দরশনে হয় তীর্থ দরশন ।।” (“শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত”)
৬) গার্হস্থ্য আশ্রম সর্বশ্রেষ্ঠ ঘোষণাঃ হরিচাঁদ ঠাকুর জানতেন সমাজোন্নতির মূল চাবিকাঠি হল মানুষের গার্হস্থ্য জীবন । একটি শিশুর জন্ম থেকে শুরু করে তাঁর বেড়ে ওঠা, মানসিক বিকাশ, শিক্ষা, কর্মজীবন, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু সব’ই ঘটে থাকে সংসারকে কেন্দ্র করেই । কাজেই শিশু যদি ভালো পরিবেশে লেখাপড়া শেখে তবেই জন্ম নেবে সঠিক চেতনা । ভাল-মন্দ বিচার করার সঠিক বোধ । তাই পবিত্রতার সঙ্গে গার্হস্থ্য জীবন-যাপন করা মানব জাতির প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য । গৃহের উন্নতি না হলে রাষ্ট্রের উন্নতি সম্ভব নয় । ঠাকুর গৃহের পবিত্রতা সর্বদা বজায় রাখতে বলতেন এবং সংযম পালনের মধ্যে দিয়ে গার্হস্থ্য জীবনকে নূতনভাবে গড়ার নির্দেশ দিতেন । গৃহ কোনো পাপাচারের জায়গা নয় বরং এখানে থেকেই মোক্ষলাভ সম্ভব । “একনারী ব্রহ্মচারী” সর্বপ্রথম তাঁর কন্ঠেই ধ্বনিত হয় । এর অন্যথা হলে গৃহের পবিত্রতা নষ্ট হয়; আর গৃহের পবিত্রতা নষ্ট হলে সমাজ নষ্ট হয় । তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গিয়ে তিনিই সর্বপ্রথম ঘোষণা করেন গার্হস্থ্য আশ্রম’ই হ’ল সর্বশ্রেষ্ঠ আশ্রম ।
৭) সতীদাহ প্রথা রোধঃ ‘পন্ডিত’ ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় কর্তৃক বিধবা বিবাহের যে আইন করেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার, তা সহজে মেনে নিতে চাননি বর্ণ হিন্দুরা । দয়াল হরিচাঁদ অতি সহজেই পূর্ববাংলা’তে (বর্তমান বাংলাদেশ) নির্মম সতীহাদ প্রথা রোধ করে বিধবা বিবাহের নির্দেশ দিয়েছিলেন ।
৮) দ্বাদশ আজ্ঞাঃ হরিচাঁদ ঠাকুর মনে করতেন সুস্থ সমাজ গড়তে মানুষের কিছু নিয়ম বা সংস্কার মেনে চলা উচিৎ । সত্যবাদী, সৎ, নিষ্ঠাবান, চরিত্রবাণ হবার শিক্ষাই মতুয়াদের মূল নীতি। তাই তিনি মতুয়াদের নির্দেশ দিয়েছেন ১২-টি নিয়ম পালনের । নীচে অতি সংক্ষেপে তা বর্ণনা করা হলঃ
(I) সদা সত্য কথা বল ।
“যত যত তীর্থ আছে অবনী মাঝারে ।
সত্যবাক্য সমকক্ষ না হইতে পারে ।।”
(II) পরস্ত্রী’কে মাতৃজ্ঞান ক’র ।
“পর নারী মাতৃতুল্য মিথ্যা নাহি ক’বে ।
পর দুঃখে দুঃখী সদা সচ্চরিত্র র’বে।।”
(III) মাতা-পিতা’কে ভক্তি কর ।
“পিতা-মাতা গাছের গোড়া, হরি গাছের ফল।
ডাল যত বাদ দিয়ে, গোড়ায় ঢালিস জল ।।”
(IV) জগৎকে প্রেম দান ক’র ।
“জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা ।
ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা ।।”
(V) চরিত্র পবিত্র ব্যক্তির প্রতি জাতিভেদ কোর না ।
“কিবা শূদ্র কিবা ন্যাসী কিবা যোগী কয় ।
যেই জানে আত্মতত্ত্ব সেই শ্রেষ্ঠ হয় ।।”
(VI) ষড়রিপুর নিকট সাবধান থাকিবে ।
“দেহের ইন্দিয় বশ না হয়েছে যার ।
তীর্থে গেলে ফল প্রাপ্তি না হইবে তাঁর।।”
(VII) কাহারও ধর্ম নিন্দা করিও না ।
“মর্ম না জানিয়া কেহ কা’রে না নিন্দিবে ।
হইলে আত্ম-বিদ্রোহ ছারেখারে যাবে ।।”
(VII) বাহ্য অঙ্গ সাধুসাজ ত্যাগ ক’র ।
“মালাটেপা ফোটাকাটা জলফেলা নাই ।
হাতে কাম মুখে নাম মনখোলা চাই ।।”
(IX) হাতে কাজ মুখে নাম কর ।
“গৃহধর্ম গৃহকর্ম করিবে সকল ।
হাতে কাম মুখে নাম ভক্তিই প্রবল ।।”
(X) ‘শ্রীহরি’ মন্দির প্রতিষ্ঠা কর ।
হরিচাঁদ ঠাকুর সত্য-প্রেম-পবিত্রতা’র মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের ‘গৃহে’ অর্থাৎ ‘হৃদয়ে’ ‘পরম দয়ালের’ মন্দির স্থাপন করতে বলেছেন ।
“সত্য বাক্য পবিত্রতা মানুষে বিশ্বাস ।
এই তিন রত্ন যার হরি তাঁর বশ ।।”
(XI) ঈশ্বর’কে আত্ম দান কর ।
এখানে উদ্ধারকারী’কেই ঈশ্বর বলা হয়েছে । প্রতিক্ষণে, প্রতিক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে হবে ।
“বিশ্ব ভরে এই নীতি দেখি পরস্পর ।
যে যারে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর ।।"
(XII) দৈনিক প্রার্থনা কর ।
একাগ্রতা আনে সাফল্যতা । তাই একাগ্রতা বৃ্দ্ধির জন্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় প্রার্থনা করতে হবে ।
“যেই ভক্ত সেই হরি ভজ নিষ্ঠা করি ।
নামের সহিত আছে আপনি শ্রীহরি ।।”
ঠাকুর হরিচাঁদ নির্দেশিত এসব গুণের অধিকারী একজন প্রকৃত গৃহী হয়ে ওঠার আসল কথা । এই আজ্ঞা জীবনমুখী ও বাস্তবসম্মত; এখানে শৃঙ্খলা আছে কিন্তু কোনো শৃঙ্খল নেই । আত্মোন্নতির মাধ্যমে সুখি পরিবার গঠন করতে দ্বাদশ আজ্ঞার মধ্য দিয়ে গার্হস্থ্য জীবন অতিবাহিত করা একান্ত কর্তব্য । পরিবার সুন্দর হলে সমাজ আপনা হতেই মজবুত হবে, দেশ সুগঠিত হবে । জাতির উন্নতির জন্য শিক্ষা এবং অর্থের কোন বিকল্প হয় না । আবার মনুষ্যত্ত্ববোধ না থাকলে সব’ই অর্থহীন হয়ে পড়ে । নিপীড়িত জাতি সমূহের একান্ত দুঃসময়ে যদি হরিচাঁদ ঠাকুরের শুভাবির্ভাব না হত, তাহলে জাতপাত, ধর্মান্ধতা, ঘৃণা-বিদ্বেষ, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, ব্যাভিচার এবং ভ্রষ্টাচারে দেশ কোথায় গিয়ে পৌঁছাত ভাবা যায় না ! তাঁর সুদূরপ্রসারী ও বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারা শুধু ভারতবর্ষ নয়, সমগ্র বিশ্ববাসী’কে পথ দেখাতে সক্ষম । শেষ জীবনে প্রিয় পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের উপরে কর্মভার অর্পণ করে এই ধর্মযোগী-কর্মযোগী ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দ বুধবারে নশ্বর দেহ ত্যাগ করে নিত্যলোকে চলে যান ।
[তথ্যসূত্রঃ ১) শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত ২) শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত]
ঠিক কথা বলেছেন। আমরা সবাই যদি নিজের ঘর আর তার মধ্যে বসবাসকারী মানুষদের নিয়ে ভাবি। তাদের সুখে রাখার চেষ্টা করি। সৎ পথে চলি। তাহলে জগতে দুঃখ-দুর্দশা থাকবে না। কিন্তু আমরা এটা ভুলে যাই। লোভ , হিংসা , ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে পাপের পাঁকে ডুবে যাই। তাই ঠাকুরের বাণীগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
উত্তরমুছুন