আলোর দিশারীঃ শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর
আলোর দিশারীঃ শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর
অন্তিম পর্ব
এছাড়াও এই বর্ণময় মহাপুরুষ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অজস্র সামাজিক কাজ করে গেছেন । লৌকিক জীবনে তিনি অনেক বাঁধা-বিপত্তি, দুঃখ যন্ত্রনা ভোগ করেছেন; এমনকি জীবিতকালে একে একে তাঁর চার পুত্রের’ই দেহাবসান ঘটে । আদর্শ বীরের মত তিনি সব সহ্য করেছেন, কোন আঘাতেই ভেঙে পড়েননি । কারণ তাঁর দেহ ও মন ছিল ধর্মের বর্মে পরিবৃত যা শান্ত শীতল ফল্গুধারা রূপে দিকে দিকে প্রবাহমান । ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে এই ধর্মবীর-কর্মবীর চলে যান মহাপ্রস্থানের পথে । পরের বৎসর অর্থাৎ ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতার এলবার্ট হলে “শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ স্মৃতিসভা” উদযাপিত হয় । যেখানে তৎকালীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু গুরুচাঁদ ঠাকুরকে ‘মহাপুরুষ’ বলে আখ্যায়িত করেন এবং গান্ধিজী তাঁর প্রেরিত শ্রদ্ধাঞ্জলি পত্রে গুরুচাঁদ ঠাকুরকে ‘মহানগুরু’ বলে সম্মান জানান ।
সংক্ষিপ্তসারঃ হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরের কর্ম-জীবন ও আদর্শ লক্ষ করলে দেখা যায়, একজন ব্যক্তি বা সমাজ কিভাবে শূন্য থেকে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে তার পূর্ণ বাস্তবায়ন । যেখানে মানুষের জৈবিক জীবন সংগ্রামের প্রতিটি স্তরের সাফল্যের বিজ্ঞানসম্মত দিকনির্দেশ করা হয়েছে । তাঁরা ধর্ম-কর্ম, ভক্তি ও প্রেমের ভিত্তির উপর “সংসার ও ভগবানের” অপূর্ব মিলনের এক চিরন্তন আদর্শ বা পথ মানব সমাজের কাছে উন্মোচন করে দিয়ে গেছেন । ঠাকুর হরিচাঁদ চাইতেন, প্রতিটি মানুষ শিক্ষা পেয়ে হয়ে উঠুক সংস্কৃতিবান ও বিশেষজ্ঞ । আত্মোন্নতির সাথে সমাজের, দেশের ও জাতির উন্নতিসাধনই হোক শিক্ষার মূল কথা ।
হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর দ্বারা সমগ্র ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপকৃত একথা অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই । তথাকথিত কেতাবী শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার উপর দাঁড়িয়ে হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর যে কাজ করে গেছেন এবং যে ধর্মপথের সন্ধান দিয়ে গেছেন তা শুধু ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল । তাঁরা দিন-রাত জেগে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে মানব জাতির মুক্তির পথ সুগম করে গিয়েছেন যা আজ বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষের ‘পিছিয়ে রাখা’ সম্প্রদায়সমূহের অগ্রগতির মূল পাথেয় । তাঁদের বাস্তবসম্মত, জীবনমুখী এবং প্রতিবাদী বিপ্লবী সত্ত্বার মাধ্যমে ঘটেছে সমাজের নবজাগরণ । সমস্ত অধিকার বঞ্চিত মানুষেরা খুঁজে পেয়েছেন আপনা ধর্ম, আপনা কর্ম । তাই একথা বলা যায়, হরিচাঁদ ঠাকুর প্রকৃত অর্থেই ‘পতিত পাবন’ । ‘মতুয়া’ শব্দটি তাঁর দেওয়া একটি উপাধি । যারা যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের ভাবধারা নিয়ে বাস্তবসম্মত পথে চলেন, তারাই মতুয়া । মতুয়ার যুক্তি আছে, ভক্তিও আছে । এই ভক্তি অন্ধ বিশ্বাস নয়, এ হল জ্ঞানমিশ্রিত ভালবাসা । এই ‘জ্ঞানমিশ্রিত ভালবাসা’ না থাকলে ব্যক্তি’র মানুষ হয়ে ওঠা সম্পূর্ণ হয় না এবং ‘নামে’ রুচি আসে না । হরিচাঁদ ঠাকুর কোন অলৌকিক দেব-দেবীর পূজা করতে বলেননি এবং কোন নূতন ধর্মেরও সৃষ্টি করেননি । তিনি মানুষকে মানবতাবাদে প্রতিস্থাপিত করেছেন । মানুষকে ভাল আর মন্দের তফাৎ বোঝার মতো পথ দেখিয়ে গেছেন । তিনি রক্ত-মাংসের দেহ নিয়ে পতিতের ঘরে পতিতের বেশে পতিতের তারণ-হার হয়ে এসেছিলেন । তাই সমস্ত ‘পিছিয়ে রাখা’ পতিত জাতির কাছে তিনি ভগবান । আমরা ভালো ভাবব, ভালো থাকব, ভালো করব, ও ভালো রাখব অর্থাৎ সার্বিক উন্নতির মাধ্যমে সামাজিক সাম্যতা প্রতিষ্ঠাই মতুয়াদের একমাত্র লক্ষ ।
জয় হরিচাঁদ । জয় গুরুচাঁদ । জয় মানবতাবাদ ।
(তথ্যসূত্রঃ "শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত")
জয় গুরুচাঁদ । জয় মানবতাবাদ ।
উত্তরমুছুন