আলোর দিশারীঃ শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর
আলোর দিশারীঃ শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর
দ্বিতীয় পর্ব
গুরুচাঁদ ঠাকুর ১৮৪৬ খ্রীষ্টাব্দে ১৩ই মার্চ দোলপূর্ণিমার দিন শুক্রবার ওড়াকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহন করেন । বাল্যকালে তিনি পাঠশালার পাঠ সমাপ্ত করে ‘মক্তবে’ আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত, ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন । পিতা যে কর্মভার তাঁর উপর অর্পণ করে গিয়েছিলেন তা মাথায় নিয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন । অতি সংক্ষিপ্তাকারে তাঁর কর্মকান্ড তুলে ধরা হলঃ
১) শিক্ষা আন্দোলনঃ গুরুচাঁদ ঠাকুর উপলব্ধি করেন, পতিত, নিপীড়িত মানুষের (যারা ভারতবর্ষের বৃহত্তর গোষ্ঠী) সার্বিক মুক্তি ঘটাতে হলে প্রথমে চাই শিক্ষার বিকাশ । তাই তিনি ঐক্যবদ্ধ মতুয়া শক্তিকে নিয়ে সর্বপ্রথমে শিক্ষা আন্দোলন শুরু করেন । সার্বিক শিক্ষার দাবীতে ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে বাংলায় চন্ডাল বিদ্রোহ সংগঠিত হয় এবং ওই বৎসরই সাম্য ও মর্যাদার দাবীতে নানা আন্দোলন কর্মসূচী গ্রহন করেন । ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে পূর্ববঙ্গের (অধুনা বাংলাদেশ) ওড়াকান্দী গ্রামের চৌধুরী বাটীতে অনুন্নত জাতির মধ্যে সর্বপ্রথম পাঠশালা গড়ে তোলেন এবং ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন । সেইদিন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে গুরুচাঁদ ঠাকুর ঘোষনা করেন-------
“যাক জান ধনমান তাতে ক্ষতি নাই,
সব দিয়ে এই দেশে স্কুল রাখা চাই ।।’’
শিক্ষার সার্বিক বিকাশের উদ্দেশে ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে তিনি পূর্ববঙ্গের (অধুনা বাংলাদেশ) খুলনা জেলার দত্তডাঙা গ্রামে ঈশ্বর গাইনের বাড়িতে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের সামনে এক ঐতিহাসিক বক্তব্য রাখেন। এই সম্মেলনের পর সর্বত্র সর্বশিক্ষা অভিযানের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে । সেখানে তিনি বলেন------
“বিদ্যা ধর্ম বিদ্যা কর্ম বিদ্যা সর্বসার।
বিদ্যা-বিনা এ জাতির নাহিক উদ্ধার।।
বিদ্যাহীন জাতি পশুর সমান।
বিদ্যার আলোকে জ্বলে ধর্ম জ্ঞান ।।”
অথবা,
“বিদ্যা যদি পাও কাহারে ডরাও
কার দ্বারে চাও ভিক্ষা।
রাজশক্তি পাবে বেদনা ঘুচিবে
কালে হবে সে পরীক্ষা ।।”
গুরুচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশে Namasudra Welfare Association গঠিত হয় । উক্ত সংগঠনে তৎকালীন ২২-টি জেলার প্রতিনিধি যোগদান করেন । ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দে তিনি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ও সারা বঙ্গদেশে স্কুল তৈরির নির্দেশ দেন । তারই নির্দেশ ও সহায়তায় বার’শ আঠারোটি বিদ্যালয় স্থাপিত হয় । পরবর্তীকালে তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মহাপ্রাণ ভক্তরা কয়েক হাজার বিদ্যালয় স্থাপন করেন । ডঃ অতুল প্রধানের গবেষণা অনুযায়ী দুই বাংলাতে (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) এখন পর্যন্ত সাড়ে-চার হাজারের উপর বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে বিভাগীয় কমিশনার স্যামুয়েল ন্যাথন সাহেবের নিকট গুরুচাঁদ ঠাকুর ছাত্রাবাস ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য বিশেষ দাবী পেশ করেন । ফলসরূপ ১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দে শিক্ষা বিভাগের অধিকর্তা পূর্ববঙ্গের (অধুনা বাংলাদেশ) নিপীড়িত জাতি সমূহের ছাত্রদের পড়াশুনার সুবিধার্থে সরকারী হোষ্টেলের ব্যবস্থা করেন । তার মধ্যে ওড়াকান্দী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরিশাল ও ঢাকা উল্লেখযোগ্য ।
২) নারী শিক্ষাঃ গুরুচাঁদ ঠাকুর নারী শিক্ষা ও তাঁদের স্বনির্ভর করে তোলার উপরও বিশেষ জোর দেন । তাঁর নিজ বাড়ীতে “শান্তি-সত্যভামা” নামে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন । (হরিচাঁদ ঠাকুরের সহধর্মীনি শান্তিদেবী এবং গুরুচাঁদ ঠাকুরের সহধর্মীনি সত্যভামাদেবী) । তাঁর উদ্দ্যেগে প্রসূতি মায়েদের সেবার জন্য ‘নারীমঙ্গল’ দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠিত হয় । কারিগরি বিদ্যালয় স্থাপন করে বেকার যুবক-যুবতীদের স্বনিযুক্তি প্রকল্পে উৎসাহ দান করা হয় ।
৩) চাকুরীর ব্যবস্থাঃ শুধু শিক্ষা বিস্তার করেই থেমে থাকেননি তিনি, ‘পিছিয়ে রাখা’ জাতির চাকুরীর জন্যও যথাযথ ব্যবস্থা করেন । ১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার গভর্নর স্যার ল্যান্সলেট বিশেষ কাজে ফরিদপুর এলে তাঁকে স্মারকলিপি প্রদান পূর্বক অনুন্নত ছেলেমেয়েদের জন্য চাকুরির দাবি করেন । লর্ড ল্যান্সলেট সেই দাবি মেনে নিয়ে সর্ব প্রথম গুরুচাঁদ ঠাকুরের পুত্র মহাত্মা শশীভূষণকে সাব রেজিস্টার পদে নিয়োগ করেন এবং কুমুদ মল্লিক, রাধামোহন সিকদার, সহ অনেকে সরকারী চাকুরী লাভ করেন । খুলে যায় সারা দেশের নিপীড়িত মানুষের জন্য চাকুরীর দুয়ার ।
৪) সংরক্ষণের ব্যবস্থাঃ ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে গুরুচাঁদ ঠাকুর ডঃ সি, এস, মীডের সহায়তায় তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আসামের লেফটন্যান্ট গভর্ণর স্যার ল্যান্সলট হেয়ারের সাথে সাক্ষাত করেন এবং দীর্ঘদিন ধরে দেশের সমস্ত শোষিত, বঞ্চিত, অত্যাচারিত মানুষগুলির জন্য বিশেষ সংরক্ষণের দাবি করেন । স্যার ল্যান্সলট হেয়ার সেই দাবি মেনে নিয়ে ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দের ৩১-শে অক্টোবর ভারতবর্ষের গভর্ণর জেনারেল লর্ড মিন্টোর নিকট অনুন্নত শ্রেণির লোকেদের উন্নয়নের জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করেন । সেই প্রস্তাবানুসারে ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইনে সর্বপ্রথম বাংলার ৩১-টি ‘পিছিয়ে রাখা’ জাতিকে শিক্ষা, চাকুরী ও আইন সভার ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রদানের কথা ঘোষণা করা হয়। তখন পর্যন্ত ভারতের বঙ্গদেশ ব্যতিরেকে অন্য কোন প্রদেশে সংরক্ষণ ব্যবস্থা ছিল না বা অন্য কোন রাজ্যে তৎকালে এই সংরক্ষণের দাবীতে কোন আন্দোলন হয়নি । ১৯১৯ খ্রীষ্টব্দে মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনে ‘পিছিয়ে রাখা’ শ্রেণির এই সংরক্ষণ ব্যবস্থা ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয় । ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে গুরুচাঁদ ঠাকুরের অনুগামী নেতৃবর্গ শ্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, শ্রী মুকুন্দ বিহারী মল্লিক, শ্রী ক্ষেত্রমোহন সিং, শ্রী দ্বারিকানাথ বারুরী, শ্রী গয়ানাথ বিশ্বাস ও শ্রী নগেন্দ্র নারায়ন রায় মিলে ডঃ বি, আর, আম্বেদকরকে গণপরিষদে নির্বাচিত করেন । যিনি এই সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেন। ব্রিটিশ সরকার ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের’ যে শর্ত দিয়েছিল তার মধ্যে সংরক্ষণকে দশ বৎসর মেনে চলার শর্তও ছিল যার মূল কান্ডারী গুরুচাঁদ ঠাকুর ।
৬) তেভাগা আন্দোলনঃ পতিত, অস্পৃশ্য সমাজের বেশীরভাগ মানুষ-ই ছিল দরিদ্র, নিঃস্ব এবং ভাগচাষী । সারা বৎসর ধরে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তাঁরা সোনার ফসল ফলাতেন । অথচ নিজেদের প্রায় অন্ন-বস্ত্রহীন হয়ে দিন কাটাতে হত । গুরুচাঁদ ঠাকুর ও তাঁর অনুগামীরা (হিন্দু-মুসলীম যৌথভাবে) কৃষকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে ‘লাঙল যার, জমি তাঁর’ স্লোগান তুলে তেভাগা আন্দোলন গড়ে তোলেন । এছাড়াও গ্রামের গরিব চাষীরা তাঁদের উৎপাদিত ফসল উপযুক্ত রাস্তাঘাটের অভাবে দূরে কোন শহরে গিয়ে বিক্রি করতে পারত না । কম মূল্যে মহাজনদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হত । দয়াল গুরুচাঁদ রাস্তা নির্মানের ব্যাপারেও বিশেষ নজর দিয়েছিলেন ।
৭) বিধবা বিবাহের রূপদানঃ তখনকার সমাজে বাল্য বিবাহ রোধ এবং বিধবা বিবাহের রূপায়নের ক্ষেত্রেও গুরুচাঁদ ঠাকুরের অবদান অসামান্য । মেয়েদের বাল্য বিবাহ অনগ্রসর সমাজের এক মহা অভিশাপ । বাল্য বিবাহের ফলে কত নিস্পাপ বালিকা বিধবা হয়ে যেত । সমাজে তাঁরা অচ্যূত হয়ে পড়ত । সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে তাঁদের জীবন যাপন করতে হত । তাই প্রতিটি সভা-সম্মেলনে করুণার সিন্ধু গুরুচাঁদ বাল্য বিবাহ রোধ ও বিধবা বিবাহের পক্ষে সওয়াল করতেন । তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় বিধবা বিবাহ কেউ মেনে নিতে চাইতো না । অবশেষে গুরুচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশে শ্রীমৎ গোপালচাঁদ সাধু ঠাকুর, রাধাচরণ চক্রবর্তী, দেবীচাঁদ ঠাকুর ও অন্যান্য অনুগামীবৃন্দ বিধবা বিবাহের সার্থক রূপদান করেন ।
৮) স্বাস্থ্য সচেতনতায়ঃ গুরুচাঁদ ঠাকুর স্বাস্থ্যের প্রতিও বিশেষ নজর দিয়েছিলেন । ঘর-বাড়ী, রাস্তা-ঘাট পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে বলতেন সর্বদাই । তিনি জানতেন স্বাস্থ্য না থাকলে সবই অচল তাই প্রতি বাড়িতে শৌচাগার নির্মাণ করতে বলতেন । কোন ভক্ত তাঁকে নিতে এলে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করতেন তাঁর বাড়িতে শৌচাগার এবং গ্রামে স্কুল আছে কিনা । যদি শুনতেন শৌচাগার বা স্কুল নেই তবে আগে সেগুলি বানাবার নির্দেশ দিতেন । তারপর তাঁর বাড়ীতে যেতেন । তিনি বলতেন --------
“স্বাস্থ্যহীন জাতি নাহি পায় গতি,
আত্মশক্তি কর রক্ষা।
শিক্ষা স্বাস্থ্য পেলে অজেয় ভূ-তলে,
আর কি বা লাগে ভিক্ষা ।।’’
৯) চন্ডাল গালি মোচনঃ তৎকালীন সময়ে সরকারি রিপোর্টে ‘পিছিয়ে রাখা’ অষ্পৃষ্য জাতির নামে অসংখ্য গালিগালাজ সহ চাঁড়াল, চন্ডাল (বিকৃত ব্যাখ্যা স্বরূপ), দাঙ্গাবাজ ইত্যাদি লেখা ছিল ।? যাতে এঁরা কোনোদিন সরকারী কোনো সুযোগ সুবিধা না পায় এবং নিজ অধিকার দাবী করতে না পারে ! ঠাকুর গুরুচাঁদ দেখলেন এ-নিয়মের পরিবর্তন না হলে সরকারী ক্ষেত্রে এ-জাতির নানারকম বাঁধার সম্মুখীন হ’তে হচ্ছে । তিনি তাঁর পার্ষদদের নিয়ে এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং সেন্সার্সের প্রধান আধিকারিক মিষ্টার গেট সাহেবের নিকট প্রতিবাদপত্র প্রদান করেন । অবশেষে ডঃ সী, এস, মিড-এর সহযোগিতায় ‘ঘৃণ্য’ সব গালিগালাজ কেঁটে সেই স্থলে নাম হয় ‘নমঃশূদ্র । (যদিও এ-নিয়ে দ্বিমত রয়েছে । কেউ কেউ বলেন ঠাকুর গুরুচাঁদ চেয়েছিলেন এ-জাতিকে তার পূর্বনাম ফিরিয়ে ‘নমোজাতি’ করতে । কিন্তু তাঁর কর্ম ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে স্বার্থান্মেষী’রা ‘নমো’ নামের সাথে ‘শূদ্র’ কথাটি যুক্ত করে বর্ণাশ্রম প্রথার সবচেয়ে নীচের শ্রেণীতে পরিণত করেছেন) । এ-জাতির গৌরবময় ইতিহাস ধ্বংস করা হয়েছে অনেক আগেই । নমোজাতি হল, ভারতবর্ষের অতি সু-প্রাচীন এক জনগোষ্ঠী । অধ্যাপক(প্রাক্তন) সুনীল কুমার রায় তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ‘নমোজাতির ইতিহাস’-এ দেখিয়েছেন যে হরপ্পা-মহেঞ্জোদেরো সভ্যতার প্রধান রূপকার ছিল এই নমোজাতি । ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য ছাড়াও বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, পাকিস্থানে এ-জাতির সন্ধান পাওয়া গেছে । ( Origin: UNESCO, 1987 report) । গবেষক জিতেন্দ্রনাথ বসু ‘এ্যাংলো-ব্যাংলো’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন নমোজাতির ব্যবহারিক ভাষা হ’ল প্রাথমিক প্রাকৃত ভাষার ঘনিষ্টতম ।
১০) ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাঃ তিনি গরিব অসহায় মানুষদের সাহায্য করবার এক অদ্ভূত উপায় বার করেছিলেন । তাঁদের টাকা ধার দিয়ে বলতেন-----“এই টাকা নিয়ে নিষ্ঠাসহকারে চাষবাস, ব্যবসা কর, লাভ পাবি । তখন আসলের সাথে কিছু বাড়তি পয়সা দিস ।” সেই বাড়তি পয়সা তিনি আবার অপরকে দিয়ে একই কথা বলতেন । বাস্তব জীবনে তিনি পিতা হরিচাঁদ ঠাকুরের ন্যায় চাষবাস, ব্যবসা সবই করেছেন । কোন কাজকেই ছোট মনে করতেন না । অর্থ ছাড়া কিছুই সম্ভব নয় । তাই তিনি সৎপথে সামর্থ অনুযায়ী যেকোন কাজের মধ্যে দিয়ে অর্থ উপার্জনের কথা বলতেন । আরও বলতেন-----অর্থকে যারা অনর্থ বলে তাঁরা অর্থের অর্থই বোঝে না । অলস মানুষদের তিনি কঠোর তিরস্কার করতেন । কাজ না করে কিছু পাওয়ার আশাকে তিনি পাপ বলে মনে করতেন । তাঁর বহুমুখী চিন্তাধারা ও কাজে মুগ্ধ হয়ে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চম জর্জ তাঁকে ‘দরবার’ মেডেল দিয়ে সম্মানিত করেন ।
১১) ভূমি সংস্কার আন্দোলনঃ ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে বরিশাল জেলার পিরোজপুরে গুরুচাঁদ ঠাকুরের সভাপতিত্বে বিশাল এক কৃষক সমাবেশে সর্বপ্রথম ভূমি সংস্কারের দাবী তোলা হয় । এরপর কৃষকদের বিভিন্ন দাবী-দাওয়া নিয়ে বাংলার বিভিন্ন জেলায় তিনি সভাসমিতি করেন । কৃষকদের স্বার্থরক্ষার জন্য তিনি ১৯৩৩ খ্রীষ্টাব্দে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনের পঞ্চম অধিবেশনে প্রধান বক্তা হিসেবে যোগদান করেন । তিনি ছিলেন কৃষক দরদী ও দরিদ্র মানুষের মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম দিশারী ।
১২) হরি-গুরুচাঁদ মিশন প্রতিষ্ঠাঃ সমাজ উন্নয়নের কাজ সর্বসমক্ষে তুলে ধরার উদ্দেশে শ্রী আদিত্য কুমার চৌধুরীর সম্পাদনায় ১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে সর্বপ্রথম ‘পিছিয়ে রাখা’ জাতির মধ্যে “নমঃশূদ্র সুহৃদ” পত্রিকা প্রকাশিত হয় । কর্মাধক্ষের কাজ করেন সুরেন্দ্র নাথ ঠাকুর (গুরুচাঁদ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র) । সমাজের সার্বিক উন্নতির জন্য ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে ওড়াকান্দী’তে ‘হরি-গুরুচাঁদ মিশন’ প্রতিষ্ঠিত হয় ।
১৩) হিন্দু মুসলীম ঐক্যঃ প্রখর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন গুরুচাঁদ বুঝেছিলেন যে হিন্দু মুসলীমের ঐক্যবদ্ধ সাংগঠনিক শক্তি ছাড়া এদেশের মানুষের ব্যাধি মুক্ত হবার নয় । তাই তিনি বলতেন--------
“বিশেষতঃ এক কথা কহি সকলেরে ।
হিন্দু মুসলমান আছি দেশ ভরে ।।
এক ভাষা এক আশা এক ব্যবসাতে ।
কেন বা করিবে রণ তাহাদের সাথে ।।
দুই ভাই এক ঠাঁই রহ মিলে মিশে ।
ভাই মেরে বল কেন মর হিংসা বিষে ।।”
কি বাস্তব চেতনাবোধ ! অথচ স্বাধীনতাকামী তৎকালীন নেতৃবৃন্দ (সবাই নন) যদি সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ ও শ্রেণীশাষন কায়েম রাখার পরিবর্তে ঐরূপ উদার জাতীয় চেতনায় উদ্বু্দ্ধ হতেন তবে দেশভাগের কলঙ্কিত চিত্র ভারত মাতার বক্ষে কোনদিন অঙ্কিত হত না এবং বাঙালী উদ্বাস্তুদের চরম দুর্দশায় পড়তে হত না । ইতিহাসের গতিপথ বদলে যেত । ভিত্তিহীন ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ খাঁড়া হত না ।
১৪) রাজনৈতিক সচেতনতা ও সংগঠনঃ রাজর্ষি গুরুচাঁদ ঠাকুর বলতেন, “রাজনীতি হ’ল শ্রেষ্ঠ নীতি, কোনো দলীয় নীতি নয় । যে নীতির দ্বারা জাগতিক সব কিছুর উপর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মনুষ্যজাতি সুন্দর হতে সুন্দরতর হতে পারে তাই হ’ল ‘রাজনীতি’ । অর্থাৎ রাজনীতির একমাত্র উদ্দেশ্য মানবজাতি তথা জগতের কল্যাণ । রাজনীতি কোন ব্যক্তিস্বার্থ বা দলীয় স্বার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় । সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে সর্বাগ্রে ব্যক্তির ‘মানুষ’ হওয়া যেমন প্রয়োজন তেমনই সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াই-এর জন্য দরকার জাত-পাত নির্বিশেষে সংঘবদ্ধ শক্তি এবং সংগঠন । হরিচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ ও কাঠামোর ঐক্যবদ্ধ শক্তি দিয়ে তিনি অনুন্নত শ্রেণির রাজনীতির বনিয়াদ গড়ে তোলেন যা গৃহীর মুক্তির জন্য অপরিহার্য । তিনি বলতেন------
“শক্তি না দেখিলে কেহ ক’রে না সম্মান ।
শক্তিশালী হ’তে সবে হও যত্নবান ।।”
১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে বাংলাদেশের খুলনা শহরে যুগনায়ক গুরুচাঁদ ঠাকুরের সভাপতিত্বে নমঃশূদ্র জাতির একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । এই সম্মেলনে অনুন্নত শ্রেণীর মানুষ কোন পথে দেশের রাজনীতি ক্ষেত্রে অংশ গ্রহণ করবে তা নির্ধারিত হয় ।
এই সম্মেলন হ’তে নমঃশূদ্র কোনপথে
চালনা করিবে রাজনীতি ।
যাহা বলে দয়াময় সভা মধ্যে পাঠ হয়
তা’তে সবে জানাল স্বীকৃতি ।।”
এই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে পশ্চিমবাংলার কাঁচড়াপাড়ায় এক সম্মেলনে “বেঙ্গল ডিপ্রেসড ক্লাসেস এ্যাসোসিয়েশন” নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয় । ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে বিধানসভার সাধারণ নির্বাচনে এই সংগঠনের পক্ষ হতে অনুন্নত সম্প্রদায়ের ২৫ জন সদস্য আইন সভায় নির্বাচিত হন । মানুষ তথা দেশের উন্নতির জন্য প্রতিটি মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করতেন তিনি । কারণ তিনি জানতেন ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিষবৃক্ষ ডাল-পালা বিস্তার করে কিভাবে সমাজের উপর চেপে বসেছে । এই বিষবৃক্ষকে সমূলে উৎখাত করতে ও মানুষের সার্বিক উন্নতির জন্য নিজেদের দল তৈরীর কথা তিনিই সর্বপ্রথম বলেন । তিনি বলতেন ---- “যে জাতির রাজা নাই, সে জাতি তাজা নয়” । জাতিকে জাগাতে রাজশক্তি অবশ্য প্রয়োজন । তিনি আত্মবলে বলিয়ান হয়ে রাজশক্তির অধিকারী হতে বলেছেন । অন্তঃসারশূন্য স্বার্থান্মেষী, ক্ষমতালোভী কোনো রাজনৈতিক দলের দাসত্ব করতে বলেননি । তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার উপর দাঁড়িয়ে এইরকম একজন ‘রাজনৈতিক গুরু’ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল । যুগ ধর্ম অনুযায়ী দেশের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারিত হয়ে থাকে । সুতরাং মতুয়া আদর্শে রাজনৈতিক দর্শন পুরোমাত্রায় রয়েছে এবং স্বয়ং গুরুচাঁদ ঠাকুরই এর পথপ্রদর্শক ।
(তথ্যসূত্রঃঃ “শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত”)
খুব তথ্যবহুল লেখা। বেশ ভালো লাগলো। আরো অনেক কিছু জানার অপেক্ষায় রইলাম ।
উত্তরমুছুন