Alor Sandgane - আলোর সন্ধানে
মতুয়া ধর্ম ‘বেদ-বিধি’র মধ্যে আবদ্ধ নয় :https://shrishriharichandthakur.blogspot.com
শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরের চিন্তাধারা-কর্মধারা কোন বাঁধা-ধরা গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় । স্থান এবং কালের সাপেক্ষে মানুষের কাছে যা কিছু মঙ্গলকর তা’ই গ্রহণযোগ্য । তাঁদের প্রতিটি কথায় ও কাজে এর পরিচয় পাওয়া যায় । হরিচাঁদ ঠাকুর ‘সতীদাহ প্রথা’ সম্পর্কে বলেছিলেন------“যারা শাস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিরাপরাধ, অসহায় মাতৃ জাতিকে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা করতে পারে, সেই শাস্ত্র-গ্রন্থ আমি মানি না”। আরও বলতেন------“মানুষের জন্য শাস্ত্র, কোন শাস্ত্র-গ্রন্থের জন্য মানুষ নয়”। তিনি সমস্ত ধর্মীয় গন্ডীর বাইরে বেরিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন সর্বক্ষেত্রেই । হরিচাঁদ ঠাকুরের ‘সঙ্গী-সাথী’-দের মধ্যে অনেক মহাপ্রাণ ভক্তরা ছিলেন । তৎকালীন কঠিন সামাজিক পরিস্থিতিতে মানুষকে সংঘবদ্ধ করা ও হরিনাম প্রচারের জন্য এদের অবদান ছিল অসামান্য । শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের তিরোধানের পর অনেকেই চরম উদাসীন হয়ে পড়েন কারণ, প্রেমেতে বিভোল ভক্ত’রা শ্রীশ্রীহরি ঠাকুর ছাড়া আর কিছু চাইতেন না । সে কি দিয়ে গেলেন, কি বলে গেলেন তা রূপের মোহে বদ্ধ ভক্ত’দের ভাববার অবকাশ ছিল না ! তাই “শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত” গ্রন্থে আচার্য মহানন্দ হালদার লিখেছেন--------
“এ হেন জনের নহে গৃহস্থের ধর্ম ।
সে কেন বুঝিতে যাবে গৃহ-ধর্ম-মর্ম ।।
রূপের পাগল চলে রূপের প্রবাহে ।
সে ভাব না বুঝে গৃহী পিছে পড়ে রহে ।।”
মানব সমাজকে পূর্ণশিক্ষা দিতে শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের আবির্ভাব । যা এক পুরুষে সম্ভব ছিল না, তাই প্রয়োজন ছিল শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের মতো একজন যোগ্য উত্তরসূরির, যাতে মানব সমাজ আবারও ভুল পথে চালিত না হয় । যা ইতিপূর্বে ভারতবর্ষের বুকে একাধিকবার ঘটেছে । মহাপুরুষেরা পথের সন্ধান দিয়েছেন একরকম আর মানব জাতি চলেছে ভিন্ন রাস্তা ধরে । মানুষ ভেবেছে তিনি তো ভগবান ! তিনি তো রাজা ! তাঁর কথা আমার কথা নয়, তাঁর কাজ আমার কাজ নয়, তাঁর পূজা করাই আমার ধর্ম !! তাই মানব জাতির পূর্ণশিক্ষার্থে জগৎগুরু গুরুচাঁদ ঠাকুর স্বীয় পিতার নীতি-আদর্শ ও নির্দেশমত কাজ করেছেন আজীবন । তিনি চাইতেন মানুষ হবে বিবেকসম্পন্ন, আত্মনির্ভরশীল । মানুষকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার জন্য তাঁকে অনেক সময় বাইরে কঠোরতা দেখাতে হয়েছে । তাঁর বাস্তববাদী ভাবধারা অনেকেই বুঝতে অসমর্থ ছিলেন । বাইরে তাঁর ছিল ঐশ্বর্যের ভাব আর অন্তরে ছিল দয়া-প্রেম-মাধুর্য । হরিচাঁদ ঠাকুর দীর্ঘকাল যাবৎ পতিত, অফলা, জলা-জঙ্গলে ভরা যে জমি আবাদী করে তুলেছিলেন, ঠাকুর গুরুচাঁদ সেখানে দায়িত্ব নিলেন সোনার ফসল ফলানোর । যেখানে চাই শুধু শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চেতনা ও রাজশক্তির অধিকার । সামাজিক সাম্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষে, যা একান্ত প্রয়োজন । এমনকি অনুন্নত সম্প্রদায়সমূহের বুকে সাহস যোগাতে তিনি নিজ পৌত্রদের উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে পাঠিয়েছিলেন । শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর একবার ভক্তদের বলেছিলেন-----আমার পিতার পূজা করবার প্রয়োজন নেই, তিনি যেভাবে জীবন-যাপন করতে বলেছেন তাই কর’গে, তাহলেই তাঁকে খুশি করতে পারবি, তাঁর দয়া পাবি । এতবড় স্বার্থহীন অকুন্ঠ মানব প্রেম সারা পৃথিবীতে বিরল । যেখানে মানুষের উন্নতিই একমাত্র কাম্য । কোনরকম অন্ধ বিশ্বাসে তিনি বিশ্বাস করতেন না । মানব জীবনের যেখানেই তিনি ভ্রষ্টাচার দেখতেন, সেখানেই তাঁর প্রতিবাদ ধ্বনিত হত । নমঃশূদ্র জাতির বিবাহ ও শ্রাদ্ধের মতো সামাজিক ক্রিয়া সম্পর্কে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন । তিনি বলেছেন -------
“বোকা জাতি নমঃশূদ্র নীতি নাহি জানে ।
শ্রাদ্ধ ও বিবাহে ব্যয় করে অকারণে ।।
ঘরে নাই অন্ন যার দেনা বহুতর ।
পিতৃ শ্রাদ্ধে করা চাই “দানের সাগর” ।।
শ্রাদ্ধ নহে পেট পুজা সাজাইয়া লয় ।
এত যে কষ্টের কড়ি সব করে ক্ষয় ।।
‘শ্রদ্ধা’তেই ‘শ্রাদ্ধ’ হয় শাস্ত্রের প্রমান ।
মূলতত্ত্ব নাহি জানে যতেক অজ্ঞান ।।
ব্রাহ্মণের কূট চক্রে নিজে ক্ষয় হয় ।
পরিণামে করে শুধু হায় ! হায় ! হায় !”
একবার শ্রীধাম ওড়াকান্দীতে হরিনাম সংকীর্তন চলাকালীন খুব জোর ‘মাতাম’(শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে হরিনাম করা) দিয়ে প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের শরীর খারাপ হয়, জ্বর আসে । তখন গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন------“ওসব পাউয়ার ছাতা করতি যাও ক্যান, যা করয়্যা জ্বর বাঁধাইয়া নইছ” ! (তথ্য সূত্র : যুগদিশা পত্রিকা, ৭ম সংখ্যা, ২০০৬ সাল, খর্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ)
সুতরাং গুরুচাঁদ ঠাকুর বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে শুধু ডংকা-কাঁসর বাজানো বা লম্ফ-ঝম্ফ করলেই মতুয়া হওয়া যায় না । এই হল বাস্তববাদী গুরুচাঁদ ঠাকুর । মানুষের মঙ্গল কামনা-ই যেখানে শেষ কথা ।
তাহলে দেখা গেল, মতুয়া ধর্ম কোন নির্দিষ্ট গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় । স্থান, কাল এবং পরিস্থিতির সাপেক্ষে মানুষের পক্ষে, সমাজের পক্ষে যা মঙ্গলকর তা’ই গ্রহনযোগ্য । ‘বেদ-বিধি’ বলতে শুধুমাত্র বেদ-এর বিধান নয়, যে কোন ‘বাঁধা ধরা নিয়ম’ বা শাস্ত্রীয় অনুশাষনকেই বোঝানো হয়েছে । সুতরাং মতুয়াধর্ম কোনরকম গন্ডীবদ্ধ নয় অর্থাৎ কোন ‘বেদ-বিধি’র মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন