Alor Sandhane - আলোর সন্ধানে
বৈদিকতার বেড়াজাল :
বৈদিকবাদীরা খুব ভাল করে জানতেন যে “ অসির চেয়ে মসির” শক্তি অনেক বেশী । অসি মানে হল অস্ত্র এবং মসি অর্থাৎ কলমের কালি অর্থে জ্ঞান । জ্ঞানের দ্বারাই নিজের অধিকার জানা যায় । তাই সর্বপ্রথম ধর্মের নামে ভারতবর্ষের মূলনিবাসী(ভারতবর্ষের আদি জাতি, প্রায় ৮৫%)-দের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল । কারণ শিক্ষিত হলে চেতনা আসবে আর চেতনা এলে অসি অর্থাৎ অস্ত্র দিয়ে মানুষকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না । মানুষের একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট হল-----কোন কিছু লিখিতাকারে বা পুস্তক আকারে দেখলে সেটা বিশ্বাস করবার প্রবণতা । তাই শুরু হল ধর্মগ্রন্থগুলির পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের কাজ, ফলে সমগ্র ভারতবর্ষ ব্রাহ্মণ্যবাদী বৈদিকতার মোড়কে ঢাকা পড়ল । আমরা ধীরে ধীরে হয়ে গেলাম বৈদিকতার গোলাম ! এখনও আমরা অসুর, দৈত্য, রাক্ষস, নাগরাজ প্রভৃতি বললেই অবাস্তব কিছু একটা কল্পনা করে বসি ! বাস্তবে এরা সবাই ছিলেন ভারতবর্ষের মূলনিবাসী এবং আমাদের পূর্বপুরুষ । ধর্ম বিশ্বাস বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান এদের মধ্যে অনেক বেশী ছিল । কোনরকম চালাকি বা ধূর্ততা এদের ছিল না । তাই এরা প্রতাড়িত হয়েছেন বারবার । আর কাল্পনিক ‘চরিত্র’রা হয়ে উঠেছেন আরাধ্য দেব-দেবী ! ভারতবর্ষের ‘মহাকাব্য’ রামায়ণ-এর কথাই ধরা যাক । ক) কবি কৃত্তিবাসের আগে দেবী দুর্গাকে কেউ চিনত না ! ঋষি বাল্মীকি রচিত মূল রামায়ণে রামের অকাল বোধন বলে কোন জিনিস নেই; কাজেই দেবী দুর্গার কোন পূজাও নেই । কৃত্তিবাসী রামায়ণে শ্রীরাম দেবীর আরাধনা করেছিলেন লংকাতে, অথচ সেখানকার মানুষ দেবীকে চেনেই না; চিনল বাঙ্গালীরা ! আর তাদের দৌলতে এখন সারা বিশ্ব । (তথ্য সূত্র: আলোক তীর্থ, ড: শৈলেন্দ্রনারায়ন ঘোষাল, প্রাক্তন ডিরেক্টর, দী বৈদিক রিসার্চ ইন্সিটিউট)। যে কাল্পনিক নারী মূর্তি পূজার জন্য সারা দেশে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়, সেদেশে নারী অধিকার ও সুরক্ষার জন্য বিশেষ আইনের প্রয়োজন হয় !! খ) রাক্ষসরাজ রাবণ তাঁর সাধন বলে সমস্ত দেবতাদের বশীভূত করেছিলেন এবং বরপ্রাপ্ত হয়েছিলেন । এখন কথা হল----- যার সাধন ক্ষমতা এত উন্নত, সে অবশ্যই পরম জ্ঞানী । সে কখনই লম্পট, চরিত্রহীন হতে পারেন না । আর যদি এসব খারাপ গুণ কারও থাকে তবে সে কখনই পরম জ্ঞানী হতে পারেন না অর্থাৎ সে সাধন বলে কখনই উন্নিত হতে পারেন না । তাহলে একথা বলা যায়, রাবণ কখনই লম্পট বা চরিত্রহীন ছিলেন না । তিনি সৎ এবং ধার্মিক রাজা ছিলেন বলেই তাঁর নামে এত অপবাদ ! এই রকম অনেক উদাহরণ আছে যেখানে দেখা যায়, কাল্পনিক দেব-দেবীর সৃষ্টির মাধ্যমে মূলনিবাসী এবং তাঁদের রাজাদের যথেচ্ছভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে ।
ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ধর্মই হল বৈদিকতার ধারক ও বাহক । যেখানে মানুষের সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে কোটি কোটি কাল্পনিক দেবতার সৃষ্টি করে নানারকম নামে প্রচার করা হয়েছে । কাল্পনিক দেবতাদের তুষ্ট করতে যেয়ে আমরা সাধারণ মানুষ সর্বশ্রান্ত হয়েছি যুগ যুগ ধরে । এই দেবতাদের আড়ালে কাদের পেট ভরেছে তা আজ বলার অপেক্ষা রাখে না । কথায় বলে-----“না কাঁদলে নিজের মা’ও দুধ দেয় না” । অথচ আমরা টাকার বিনিময়ে অপরকে দিয়ে পূজা করিয়ে ঈশ্বরের কৃপালাভ করবার চেষ্টা করি ! কি অদ্ভুত বিচারধারা আমাদের ! ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নিজেদের স্বার্থরক্ষা ও উদ্দেশ্য চিরস্থায়ী করবার জন্য সমাজের বুকে যে বিষপ্রয়োগ করেছেন সেটা আমরা শিক্ষিত হয়েও বোঝার চেষ্টা করি না । হয়তো বা বেশী বুঝে তাঁদেরকে টেক্কা দেবার খেলায় মেতেছি ! ফলস্বরূপ এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছি বৈদিকতার বিষ-জালে যে সেখান থেকে বেড়িয়ে আসার পথ খুঁজতে গিয়ে দিকভ্রান্ত হয়ে পরছি । তাই বোধহয় এত সামাজিক অরাজকতা !!! একটা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত কখনই আর একটা ভুল হতে পারে না । যে দেশের সিংহ ভাগ মানুষের থাকে না শিক্ষার অধিকার, আত্মধর্ম রক্ষার অধিকার, রাজনীতির অধিকার সে দেশের উন্নতি কিভাবে সম্ভব !! ‘দেশ’ মানে তো দেশের মানুষ । ‘দেশ’ কথা বলে মানুষের মুখে । তাই ভারতবর্ষ কেন কাদের কারনে বারংবার বিদেশীদের দ্বারা লুন্ঠিত হয়েছে তাঁর কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না । কিন্তু দুঃখের বিষয় আজকের দিনেও বৈদিকতার নেশা আমরা সম্পূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারিনি । তাই আত্ম-বিকৃতি ও আদর্শহীনতায় ভুগছি । যে বা যাদের কারণে আমাদের দেশ কয়েক’শ বৎসর পিছিয়ে গেছে, আজকের দিনেও সেই ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ’কে এগিয়ে নিয়ে চলেছি আমরা বেশিরভাগ মূলনিবাসীরাই । ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মের প্রবক্তারা ছিলেন সুচতুর এবং কৌশলী । তাঁরা সংখ্যা-লঘু হয়েও রাজশক্তির সহায়তায় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়গুলির উপর আধিপত্য বিস্তার করবার জন্য তাঁদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত করে রেখেছিল । সমাজের এই বিভাগকরণ প্রক্রিয়া আজও সমান ভাবে অব্যাহত ।
ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির গতিশীলতাই অনুন্নত শ্রেণীগুলির দাসত্বের কারণ । একটি উপমা দিলে এর বাস্তবতা পরিস্কার হবে । আমরা বেশীরভাগ বাঙালীরা কালীপূজা নিয়ে মেতে উঠি । প্রসিদ্ধ ‘সাধক’ রামপ্রসাদ বলেছিলেন------“আমি মদ খাইনে মা, মাতাল হই মা কালী বলে....।” অর্থাৎ তিনি মদ খেয়ে মাতাল হবার কথা বলেননি, বলেছেন একাগ্র চিত্তে ‘কালী-কালী’ বলে মাতাল হবার কথা অর্থাৎ দেহের লুক্কায়িত শক্তি জাগরণের কথা । অথচ বাস্তবে দেখা যায় এবং অধিকাংশ লোকই বলেন মদ এবং পাঁঠাবলি ছাড়া নাকি কালী পূজা হয় না । এখন এর বাস্তবতা নিয়ে একটু ভাবা যাক । মহান মুনি-ঋষিগণ ও আত্মজ্ঞানী মহাপুরুষেরা স্বীকার করেছেন যে পরম-সত্ত্বাকে অনুভব করার প্রধান শর্ত হল সুস্থ শরীর ও শুদ্ধ মন । এখন প্রশ্ন হল ক) মদ ও পাঁঠার মাংস গ্রহণের দ্বারা কি দেহ বা মনের সুস্থতা আসে ? যদি না আসে তাহলে কেন এই অপভ্রংশতা ? খ) পরমদয়ালের কাছে তাঁর’ই সৃজিত জীবকে তাঁকে’ই খুশী করার জন্য ‘বলি’ দেওয়ার মতো জঘন্য খেলার অধিকার মানুষকে কে দিল ? এতে নাকি ‘মা’ খুশি হন-----নিজের সন্তানের মরণ ও মানুষের বিকৃত লালসা দেখে !!! কতদিন চলবে ধর্মের নামে এইসব ভন্ডামী আমাদের দেশে ??? যারা মনে করেন মদ ও বলি ছাড়া কালী পূজা হয় না, ভদ্র ভাষাতে তাঁরা হলেন ভন্ড এবং সমাজের শত্রু । পূজার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল আত্মোন্নতি । সঠিক পথ এবং দেহ ও মন সুস্থ না হলে আত্মোন্নতি তো দূর অস্ত, আত্মবিকৃতি অবশ্যম্ভাবি ! তাহলে এই পূজার যৌক্তিকতা কোথায় ? এই সমস্ত ভ্রান্ত চিন্তাধারা এবং অরাজকতা আমাদের রক্তের সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে ভাল মন্দের বোধটুকুও আমরা হারিয়ে ফেলেছি এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী অপসংস্কৃতিকে বহন করে চলেছি । তাই আজ হতে প্রায় একশত বিশ বৎসর পূর্বে মুদ্রিত “সীতানাথ বিশ্বাস” তাঁর “জাতিতত্ত্ব ও নমস্য কুলদর্পন” পুস্তকে লিখেছিলেন-----“হায়রে ব্রাহ্মণ্য-ধর্ম ও ব্রাহ্মণসমাজ ! এইরূপ কূট প্ররোচনায় ও দুষ্ট চক্রান্তে আমাদের অতীত হইতে এ পর্যন্ত কত যে সর্বনাশ সাধন করিয়া আসিতেছে, আমরা তোমার মোহে মুগ্ধ ভক্তগণ তাহা ভাবিয়া একবারও আত্মধর্ম বা যথার্থ স্বরাজ লাভে উদগ্রীব হইতেছি না । যাহারা মানুষকে শৃগাল কুকুরাপেক্ষাও ঘৃণা করেন, এমন ব্রাহ্মণদিগকে প্রভুত্বের সিংহাসন দিয়া, তাহাদের বিধি ব্যবস্থার শৃঙ্খল পশুর ন্যায় বহন করাই ধর্মের আচরণ বলিয়া ভাবিতেছি ।” আমরা সত্যিই যদি নিজের ভাল চাই, দেশের মঙ্গল চাই এবং নবজাতকের কাছে সত্যিই কোন অঙ্গীকার থেকে থাকে, তাহলে এই বিষবৃক্ষের মূল কোথায় তা আমাদের অতি সত্ত্বর খুঁজে বের করে সমূলে উৎখাত করতে হবে । তবেই মিলবে আলোর সন্ধান, যার জন্য সর্বাগ্রে চাই বাস্তবসম্মত চেতনাবোধ ও সঠিক পথে চলা । ঠিক এমনই এক বস্তুবাদী, যুক্তিবাদী, স্বাধীন ও সতন্ত্র পথ দেখিয়ে গেছেন যুগাবতার শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও তাঁর পুত্র শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর । মানুষের আত্মোন্নতি হতে শুরু করে সমাজ তথা দেশের সার্বিক উন্নতিই যেখানে শেষ কথা ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন