আলোর সন্ধানে
প্রথম পর্বঃ
এখন কম্পিউটার মোবাইলের যুগ । বিজ্ঞানের দৌলতে আজ আমরা মঙ্গলেও পাড়ি দিয়েছি । একেবারে শুরু থেকে আজ অবধি প্রকৃতির যত ধরনের পরিবর্তন হয়েছে-----সে জলবায়ু গত হোক বা জীবজগতেরই হোক, প্রকৃতির নিজের প্রয়োজনেই সব হয়েছে । অর্থাৎ প্রকৃতির নিজের চলার একরকম ভঙ্গিমা আছে । যখন সে ভঙ্গিমা কোনভাবে বাধা প্রাপ্ত হয় তখনই প্রকৃতি নিজের মতো করে নিজেকে সাজিয়ে নেবার চেষ্টা করে । ফলস্বরূপ জীবকুল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই । যেমন সুনামি । সুনামি হয়েছিল প্রকৃতির প্রয়োজনেই । আমরা প্রকৃতির একটি অতি ক্ষুদ্র জীব, তাঁর চলার পথ রুদ্ধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই । আসলে আমরা বোধহয় ভেবে ফেলি-----আমরাই প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ কর্তা ! আমরা মোহাচ্ছন্ন জীব------তাঁর হাতের পুতুল মাত্র ! প্রকৃতির প্রয়োজনেই আমাদের এই পৃথিবীতে আসা, আবার তাঁর কারণেই তাঁর’ই সাথে বিলীন হয়ে যাওয়া । এটাই জীবন চক্র । তাঁর চলার পথকে সুগম করাই আমাদের কর্তব্য ।
পৃথিবীতে প্রথম নিউক্লীয়াসবিহীন জীবকোষের আবির্ভাব ঘটে প্রায় ৩৮০ কোটি বৎসর পূর্বে । তারপর ধীরে ধীরে বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন রকম জীবের আবির্ভাব ঘটেছে । প্রথম মানুষাকৃতি জীবের আবির্ভাব ঘটে প্রায় ৮০ লক্ষ বৎসর পূর্বে আর অধুনা মানুষের বয়স প্রায় ১ লক্ষ বৎসর । অর্থাৎ প্রকৃতি পরিবর্তনশীল আর জীবজগৎও প্রকৃতির সাথে সাথে পরিবর্তনশীল । আমরা মানুষ প্রজাতি জীবজগতের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত মস্তিষ্কের ; আমাদের বিবেক-বোধ আছে অর্থাৎ ভালো মন্দের বিচার করতে পারি আর সৃষ্টিশীল চিন্তা করতে পারি । তাই জ্ঞানের দ্বারা বৈজ্ঞানিকভাবে সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে চলেছি এক অসীম-অনন্তের দিকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই । পরিবর্তনশীল এই প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও দেশ কাল অনুযায়ী নিজস্ব ভঙ্গিমা বা চলার ছন্দ তৈরী করে নিয়েছি । যেমন আমরা বনচারী হতে ঘর বাঁধতে শিখেছি তেমনই নিজেদের প্রয়োজনেই শিখেছি সুসংঘবদ্ধ সমাজ, রাজ্য বা দেশ গড়তে যাতে সামাজিক বা অর্থনৈতিক ভাবে আমরা আরও ভালভাবে জীবন যাপন করতে পারি । এই ‘আরও ভালভাবে’ করতে গিয়ে আমরা কত কি না করে চলেছি ! তৈরী হয়েছে বিজ্ঞানের কত শাখা । জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে তৈরী করতে হচ্ছে কর্মসংস্থানেরও নিত্য-নূতন দিক । সুতরাং প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে পাল্লা দিয়ে আমরাও নিজেদের পরিবর্তিত করছি । এখন প্রশ্ন হল------প্রকৃতির প্রয়োজনে আমাদের পরিবর্তন দরকার, কিন্তু আমাদের কারণে প্রকৃতির পরিবর্তন সঠিক কি ? নিশ্চয়ই নয়, বিজ্ঞানীরা তাই বলেন । এই প্রকৃতি আসলে কি ? প্রকৃতির নিজস্ব চলার ভঙ্গিমা আছে কেন ? প্রকৃতি পরিবর্তনশীল কেন ? পৃথিবীর বাইরে প্রকৃতির অস্থিত্ব কি ? এরকম অনেক প্রশ্ন হতে পারে । আমরা বিজ্ঞানের দৌলতে জেনেছি------পৃথিবী সৌরজগতের একটি গ্রহ । এখানে জীবকোষ গঠিত হবার মত উপযুক্ত পরিবেশ ছিল বলেই আজ আমরা মানুষ হয়েছি । মহাবিশ্বে সৌরজগতের মত কোটি কোটি জগত আছে । সবাই সুনির্দিষ্ট নিয়মে গতিশীল । এখানেও প্রশ্ন আসে সবাই সুনির্দিষ্ট নিয়মে গতিশীল কেন ? পৃথিবী ছাড়া আর কোথায় জীবের অস্থিত্ব আছে ? বিশ্বব্রহ্মান্ডের শেষ কোথায় ? তার বাইরেই বা কি আছে ? মহাবিশ্ব সম্মন্ধে এরকম প্রশ্নের শেষ নেই যার উত্তর বোধহয় ‘জানি না’ ছাড়া অন্য কিছু হয় না । আমরা শুধু বিজ্ঞানের সাহায্যে এগিয়ে চলেছি মাত্র------অজানাকে জানার, অধরাকে ধরার । আর ঠিক এখানেই একটি ‘অসীম’ বা ‘পরম শক্তির’ কল্পনা এসে যায়, যার দ্বারা বিশ্বব্রহ্মান্ডের সমস্ত কিছু সুনির্দিষ্টভাবে চালিত এবং সৃষ্টি । বিশ্বব্রহ্মান্ডে জীব বা জড় সবকিছুই অসীম শক্তির এক একটি অংশ বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে । কারণ বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির মূলে রয়েছে ভর ও শক্তির রূপান্তরের খেলা । যে অসীম শক্তির দ্বারা সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রন, তাঁর দ্বারাই সমস্ত জীব ও জড়ের সৃষ্টি । যার উপস্থিতি সমস্ত অণু-পরমাণু, জীব-জড়, জল-স্থল অন্তরীক্ষ সর্বত্রই সবসময়, যে নিজেই মহাকাল, যার শুরু নাই আবার শেষও নাই, যাকে চোখে দেখা যায় না, যার মধ্যে কোটি কোটি সূর্যের তেজ বর্তমান এবং অবশ্যই ‘নিরাকার’ ----- এ’হেন ‘এক’ এবং ‘অদ্বিতীয়’ অসীম শক্তিকে কেউ আমরা ঈশ্বর, আল্লাহ বা গড্ বলে ভাবি । ‘ভাবনা’-টা বোধহয় অস্বাভাবিক নয়, কারণ আমাদের মনে ভয় আছে এবং আমরা ভাবতে পারি ! এই পর্যন্ত কোন গোল নেই । কিন্তু যখনই ভাবনার দৌড় গাছে ওঠে, শুরু হয় গন্ডগোল । এই ‘অসীম শক্তির’ পক্ষে কি ‘সসীম’ বা ক্ষুদ্র মানুষ হয়ে এই গ্রহতে বার বার অবতারিত হওয়া সম্ভব ? তাও কিনা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে ! তাহলে ভারতবর্ষে এত দুর্নীতি কেন ? যার মূল অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে ‘ধর্ম’ নামক এক ‘অধর্মের’ আফিংয়ে দেশটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে । এই কি ‘অসীম শক্তি’র শক্তির নমুনা ! তিনি কি বারংবার মানবজাতিকে ভুল পথে চালিত করতে বা সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করতে আসেন ? অসীম শক্তিকে মনুষ্যরূপী অবতার বলা হলে তাকে কি অতি ক্ষীণ বা খর্ব করা হয় না ? যতদিন মানুষের মনে ভয় বা দুর্বলতা নামক কোন বস্তু থাকবে ততদিন ঈশ্বর, আল্লাহ বা গড্–এ বিশ্বাস থাকবে । তাঁর মানে তো এই নয় যে আমরা কল্পনার আশ্রয় নিয়ে যা খুশী তাই বলব এবং করব !
তাহলে দেখা গেল, ‘পরম শক্তি’ কখনই মানুষরূপে জন্মগ্রহণ করতে পারেন না । অথচ ভারতবর্ষে বৈদিকতার মোড়কে যে অবতারবাদের ছড়াছড়ি সেখানে অসীম শক্তিকে মানুষরূপে স্থাপন করা হয়েছে ! ফলে ভারতবর্ষের সরল, সৎ এবং ধর্মভীরু মানুষেরা হয়েছেন ধর্মচ্যূত ! এ-প্রসঙ্গে একটি উপমা দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে । গীতার নবম অধ্যায়ের বত্রিশ নং শ্লোক, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন------ “Man hi Partha, vyapastritya ye pi syuh papa yonah striyo vaishyas tatha sudras te pi yanti param gatim.” [O Arjuna, even those who may be born from the wombs of degraded woman, merchants and menials… if they take full shelter of me, they also reach the supreme goal]
বাণীটির অর্থ হল --- “হে অর্জুন, যাদের পাপ যোনি হতে জন্ম (অর্থাৎ যারা পিতৃ পরিচয়হীন ) সেই বৈশ্য ও শূদ্রগণ যদি সম্পূর্ণভাবে আমার শরণাগত হয় তবে তাঁরাও চরম লক্ষে পৌঁছাতে সামর্থ হবে ।” কথা হল, এইরকম একটি বর্ণবৈষম্যমূলক, সমাজবিরোধী এবং মাতৃজাতির প্রতি চরম অবমাননাকারী ‘বাণী’ শ্রীকৃষ্ণের মতো একজন ‘চরিত্র’ কি আদৌ বলতে পারেন ??? শ্রীকৃষ্ণ যে এমন কথা বলতে পারেন না তার অনেক প্রমাণ রয়েছে । আসল সত্য হল, শ্রীকৃষ্ণের মুখ দিয়ে এমন কথা বের করিয়ে নেওয়া হয়েছে অতি সুকৌশলে । ঠিক যেমন মহাভারতের শ্লোক সংখা ৫,৬০০ হতে আজকের ডেট-এ দাঁড়িয়েছে ৯৬,০০০ !!! দেশের সিংহভাগ মানুষের সরল বিশ্বাস, উদারতা ও সৎ মনোভাবের সুযোগ নিয়েছেন সমাজের এক চতুর অংশ । যারা ছলে-বলে-কৌশলে সর্বদাই থাকতে চেয়েছেন উচ্চস্হানে, সমাজ তথা দেশকে পঙ্গু করে হলেও । একই ধারা (tradition) আজও চলছে সমানভাবে --- মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে প্রচুর ক্ষমতা ও অর্থ, তবুও এদেশের অবস্থা শোচনীয় ! এইরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যার থেকে বোঝা যায় আমরা কোন এক অশুভ শক্তির দ্বারা প্রতাড়িত হয়ে ভুল পথে চলেছি দীর্ঘদিন যাবৎ । বাস্তব চেতনাবোধ হারিয়ে নানারকম কল্পনাশ্রিত হয়ে (বা বাধ্য হয়ে) প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারিনি । আত্মধর্ম ভুলে অশুভ শক্তির দ্বারা চালিত অধর্মকে’ই ধর্ম বলে স্বীকার করে নিয়েছি মনে প্রাণে । ফলস্বরূপ সমাজ এবং প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে । তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বীকারোক্তি ------ “তোমার পূজার ছলে, তোমায় ভুলে থাকি” ।
(চলবে)
খুব ভালো বর্ণনা করেছেন। বিজ্ঞান এর সাথে আধ্যাত্মর মেলবন্ধন ঘটিয়ে যুক্তি সহকারে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
উত্তরমুছুন