Alor Sandhane - আলোর সন্ধানে
দ্বিতীয় পর্বঃ
শিক্ষা, সংবাদ মাধ্যম ও বর্তমান সমাজ :
আজ আমরা একবিংশ শতাব্দীর সভ্য মানুষ । আমাদের মধ্যে শিক্ষার হারও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আমরা সংস্কারহীন, সচেতন মানুষ বলে নিজেদের দাবী করি । অথচ একটু আত্মবিশ্লেষন করে দেখার চেষ্টা করি না, আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি ! আধুনিকতার নামে ধর্মপথ থেকে কতখানি সরে গিয়েছি ! চোখ কান খোলা রাখলে প্রায়শই দেখা যায় নানারকম বিকৃত ও অসামাজিক কার্যকলাপ যেমন গালিবাজি, বোমাবাজি, মদ্যপান ও নানারকম মাদকদ্রব্যের বাড়বাড়ন্ত, অপরকে সম্মান না দেওয়া, ধর্ষণ, গৃহবিবাদ, বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া, অবৈধ সম্পর্ক সহ নানারকম ঘটনা । প্রশ্ন হল, এ কেমন শিক্ষায় শিক্ষিত আমরা, কেমনই বা আমাদের সচেতনতা যার দ্বারা সমাজ আজ এক ভয়ংকর জায়গাতে ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে ? তবুও আমরা মানুষ, একবিংশ শতাব্দির শিক্ষিত সভ্য মানুষ !!
এক কথায় আমরা নিজেরা, পারিপার্শিক পরিবেশ, সংবাদ মাধ্যম এবং ভারতবর্ষের ‘তথাকথিত’ ধর্ম’কেই দায়ী বলে মনে হয় । এ বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক ।
১। আমরা নিজেরা কেন দায়ী : স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র মিলনে মাতৃ জঠরে ভ্রূনের সৃষ্টি হয় । এই ভ্রূন মাতৃগর্ভে ২৮০ দিন, কি সামান্য কম-বেশী সময় পর্যন্ত থাকে । এই পবিত্র মিলনের সময় থেকে শুরু করে ২৮০ দিন পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রীর মনের সমস্ত রকম প্রতিক্রিয়া (ভালো বা মন্দ) স্থানান্তরিত হতে থাকে ওই ভ্রূনের মধ্যে আমাদের অজান্তে । যেমন কাম, ক্রোধ, লোভ, হিংসা, মদ্যপান, কাউকে ঠকানো, চুরি করা, কাউকে অন্যায়ভাবে অপমানিত করা বা নিজে অপমানিত হওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি খারাপ গুণগুলি প্রবেশ করে ভ্রূণের মধ্যে । উপযুক্ত সময় আর পরিবেশ পেলে সন্তানের মধ্যে ওই সব গুণগুলির প্রকট হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল থেকে প্রবলতর ! জ্ঞানাস্ত্র ও সংযম দ্বারা এর নিয়ন্ত্রণ কঠিন হলেও সম্ভব । বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ওই সন্তানেরা হয়ে যায় জ্ঞানপাপী !! আমরা সকলে জানি, দেবী পদ্মাবতীর গর্ভে মহামানবী দেবকী’র জন্ম-কাহিনী, আবার এও মনে রাখা দরকার যে, সামান্য (?) ভুলের জন্য একই গর্ভে দুষ্ট-দুরাচারী কংসেরও জন্ম হয়েছিল !! এত গেল অঙ্কুরোদ্গমের কাহিনী, এরপর তাকে উপযুক্ত আলো, বাতাস, সার দিতে হবে যার প্রথম সূত্রপাত গৃহাশ্রম হতেই ।
২। পারিপার্শিক পরিবেশ : শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটতে থাকে তাঁর বাড়ি, স্কুল এবং পারিপার্শিক পরিবেশের নানারকম ঘটনার মধ্য দিয়ে । প্রথমত, প্রতিটি শিশু সর্বপ্রথম অনুকরণ করতে শেখে তার মাতা-পিতাকে । তাদের কথা-বার্তা, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার শিশুরা খুব নিখুঁত ভাবে অনুকরণ করে । কাজেই তাঁদের সম্পর্কের বাঁধন কতটা মজবুত তার উপর নির্ভর করবে শিশুর প্রাথমিক বিকাশ ও শিক্ষা । দ্বিতীয়ত, স্কুলকে মানুষ তৈরীর কারখানা বলা হয় । ‘মানুষ’ মানে যে শুধু কেতাবী শিক্ষা বা বেশী নাম্বার পাওয়া নয়, এর বাইরেও যে মূল্যবোধের শিক্ষার প্রয়োজন তা প্রতিটি শিক্ষক এবং পিতা-মাতাদের ভালো করে জানা প্রয়োজন ! তৃতীয়ত, দেখা যায় চারিদিকে অবৈধ মাদকদ্রব্যের ব্যবসা, নানারকম অশ্লীল পোষ্টার, সিনেমা এবং ছবি। আমাদের দেশের সরকার বা ‘সেন্সর বোর্ড’ বোধহয় ভুলে গেছেন-----এ সব কিছুর সম্পর্ক থাকা উচিত দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে । অপরকে নকল করা ভালো যদি সেটা দশের ও দেশের পক্ষে মঙ্গলদায়ক হয়, অন্ধ অনুকরণ ‘সর্বনাশ’ ডেকে আনে । মনে রাখতে হবে, তাৎক্ষনিক আনন্দ মানেই জীবন আনন্দময় নয় । আমাদের প্রকৃত উন্নতি আমাদের মত করেই হতে পারে । সে শক্তি আমাদের মধ্যেই নিহিত আছে ! এছাড়া দেশ চালানো আমাদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ ! যে ভাষা ব্যবহার করছেন আজকাল বিভিন্ন সভা-সম্মেলন বা মিডিয়ার সামনে তাতে শিশু বা যুব সমাজের কাছে কি বার্তা পৌঁছাচ্ছে তা আমাদের ভাববার সময় এসেছে । অনেকে বলে থাকেন, ‘এসবের থেকে দূরে রাখব আমার সন্তানকে’------এটা অবাস্তব ভাবনা ছাড়া আর কিছু নয় । অথচ আমরা ইঁদুর দৌড়ে এতটাই ব্যস্ত যে কোনদিকে তাকানোর মত সময়ই আমাদের নেই । শুধু আত্মসুখ আর আমি । আমি বা আমরা কোথায় চলেছি, সে হুঁস নেই আমাদের !
৩। সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা : আমরা জানি মিডিয়ার দ্বারা সমাজের নানারকম ঘটমান সত্যের প্রতিফলন ঘটে । সংক্ষেপে, যার সাহায্যে মানুষ দেশ-বিদেশের নানারকম খবর জানতে পারে, সচেতন হয়, জ্ঞানের পরিধি বাড়ে অর্থাৎ সমাজ জাগ্রত হয় । এককথায় সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা আমাদের কাছে অপরিসীম এবং ‘মাধ্যম’ নামক ‘ব্যক্তিটি’র সততা ও মূল্যবোধ সমাজের কাছে ভীষণ জরুরি ও মূল্যবান ।
বাস্তবে দেখা যায়, মাধ্যমগুলি সত্য-মিথ্যা, মূল্যবোধ, দেশের সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সামাজিক প্রভাব কোনোকিছু পরোয়া না করে শুধুমাত্র অর্থের লোভে মানুষের সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে নানারকম বিকৃত, মিথ্যা বা কোন খারাপ জিনিসের যে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে,(অনেক সময় কুরুচিকর ভাবে) তা কি সর্বদাই গ্রহনযোগ্য ? সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের পিছনে এর কি কোনো ভূমিকা নেই ?? যদি না হয় তাহলে আমরা চুপ কেন ?? কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এই পৃথিবীকে ‘‘নবজাতকের বাসযোগ্য’’ করে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছিলেন, আমাদের কি কোন অঙ্গীকার থাকবে না তাঁদের কাছে ? বর্তমান সমাজে অর্থ, চাকরী, বাড়ি, গাড়ী কোনো কিছুই বোধহয় মানুষকে সুখী করতে পারে না; যদি ‘শান্তি দেবী’ হৃদয়ে না বাস করেন ! ‘শান্তিদেবী’র বড়ই করুণ অবস্থা আমাদের দেশে, কেউ তাঁকে ঠাঁই দেয় না; তাই তিনি মনের দুয়ারে-দুয়ারে ঘুরে শ্রান্ত হন একটু আশ্রয়ের খোঁজে, কিন্তু তিনি সামান্য জায়গাটুকুও পান না কারণ ওখানে আগেই দখলদারী নিয়েছে ‘ষড়রিপু’ ও ‘মিথ্যাবাদী’রা । তাই বোধহয় বিকৃত কার্যকলাপ দিন দিন বেড়েই চলেছে । সরকার ও বিরোধী পক্ষের তরজা এবং শেষমেষ অপরাধীর সাজা পাওয়া বা না পাওয়া----এসবের উপর অপরাধ কমে না, সাময়িকভাবে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে মাত্র । কারণ এ-রোগের শিকড় অতি গভীরে...। এভাবে চলতে থাকলে সমগ্র ভারতবর্ষ চরম দুর্দিনের সম্মুখীন হবেই ! আমাদের সম্মীলিত কঠোর প্রয়াস ও কন্ঠস্বরই একমাত্র পারে এ সমাজকে বিষমুক্ত করতে; কোনো ‘সরকার’ বা ‘সেন্সর’ বোর্ড নয় । মনে রাখতে হবে গণতান্ত্রিক দেশে আমরাই সরকার, আমরাই সেন্সর বোর্ড, আমরাই সব । দুটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও ভালো বোঝা যাবে । ক) আমরা সকলে ক্রিকেট খেলা ও সিনেমা দেখি । প্রিয় ক্রিকেটার বা সিনেমার হিরো একটু ভালো করলে তাঁকে বাহবা দিয়ে ভরিয়ে দিই । দেখা যায়, কিছু ক্রিকেটার বা হিরো অনেক টিন্-এজার বা শিশুদের কাছে রোল মডেল ! এখন এই রোল মডেলরা (?) মাঝে মধ্যেই দেখা যায় কোনো নামী মদ কোম্পানির জার্সি পরে খেলছেন অথবা বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন । সরল শিশু মনে এবং সমাজে এর কী প্রভাব, তাতে ঔ সামাজিক ভদ্র রোল মডেলদের কিছু যায় আসে না ! অদ্ভূৎ ভাবে আমরাও সব হজম করে নিচ্ছি ! একবারও ভাবছি না “আমারে (তোমারে) বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে !!!’’
খ) টিভি খুললেই চোখে পড়ে বিভিন্ন চ্যানেলে জ্যোতিষ-আচার্য্য এবং নানারকম খেলনার (বিভিন্ন দেব-দেবীর অনুকরণে) বিজ্ঞাপন । ওসব নিয়ে ঘরে রাখলে নাকি সমস্ত আপদ-বিপদ তো যাবেই উপরন্তু ঔ দেব-দেবীর কৃপাতে ঐশ্বর্যশালীও হওয়া যাবে; এটা ওনারা বেশ জোরের সঙ্গেই বলেন এবং প্রচুর দর্শক একেবারে ভক্তিতে গদ্গদ্ হয়ে এসব কথা শোনেন ও ফাঁদে পা দেন । কোনোরকম তন্ত্র-মন্ত্র, ভোজ্-ভেল্কী বা শ্রম না করে সহজলোভ্য জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হওয়াটা পাপ ছাড়া আর কিছু নয় । এ জগতে কর্ম ও কর্মফলের বাইরে আর কিছু নেই, থাকতে পারে না । সু-কর্মের সুফল আর কু-কর্মের কুফল ভোগ করতেই হবে । কর্মফল এড়িয়ে যাবার ক্ষমতা কার’ও নেই সে মানুষ হোক বা ঈশ্বর । সু-কর্মে মনে কখনই পাপ-বোধ আসে না কিন্তু কু-কর্ম হতে পাপ-বোধ সৃষ্টি হয় । এই পাপ-বোধ হতে আসে ভয় । আর এই ভয়’ই মানুষকে বিপথে চালিত করে । তাই বোধহয় এই জ্যোতিষ-আচার্য্যদের এত রমরমা ও বিজ্ঞাপনের হুজুক !
৪। ধর্মের ভূমিকা : ধর্ম হল বাস্তবসম্মত জ্ঞান ও বাস্তবসম্মত পথে চলা; কোনো কাল্পনিক দেবতার পূজার্চনা নয় । যে ‘ধর্মাদর্শ’ আমাদের বাস্তববোধের শিক্ষা দেয় সেটাই গ্রহণযোগ্য । একথা সত্য যে অখন্ড ভারতবর্ষে, কয়েক হাজার বছর ধরে ধর্মের নামে শুধুই চলেছে অধর্ম আর বর্বরতা; যার রেশ্ কিছুটা কমলেও, এখনও চলছে শুধু রং পাল্টেছে । আর সুযোগ সন্ধানী স্বার্থান্মেষীরা ওটাকেই তাঁদের ‘মহান ধর্ম’ বলে চালাচ্ছেন । ‘তাঁদের’ ধর্ম এই জন্যই কারণ, ভারতবর্ষের বৃহত্তর গোষ্ঠির ওই ধর্মের কারণেই লেখাপড়ার কোন অধিকার ছিল না; কাজেই ভারতবর্ষের এই বৃহত্তর অংশের ওই শাস্ত্র গ্রন্থও নয় আর ওই ধর্মও নয় । তবে একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, ওই অধর্মের অনুশাসনে, যাতাকলে পড়ে এবং রাজশক্তির ভয়ে অখন্ড ভারতবর্ষের এই বৃহত্তর গোষ্ঠী ওই ‘অধর্ম’ কেই ধর্ম বলে মানতে শুরু করেছিলেন । যারা মানতে পারেননি, এমনকি প্রাণের মায়া ত্যাগ করেও, তারা পতিত জাতি, অস্পৃশ্য, চাড়াল ইত্যাদিতে পরিণত হয়েছিলেন । অথচ এরাই ছিলেন প্রকৃতপক্ষে ধার্মিক বা আদর্শবাদী । আর যে বৃহত্তর গোষ্ঠী অধর্মকে ধর্ম বলে মানতে শুরু করেছিল দীর্ঘ বৎসর যাবৎ তাদের মধ্যে অধর্মের বিষ এমনভাবে মিশে গিয়েছে যে তাঁরা এখনও পুরোপুরি বুঝতে অক্ষম কি করনীয় আর কি করনীয় নয় ! একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিস্কার হবে । আমাদের দেশে এমন অনেক পরিবার আছে যাদের রাত পোহালেই ভাত-রুটির চিন্তা করতে হয়; অর্থের অভাবে ছেলে-মেয়েদের লখাপড়া ঠিকমতো হয় না----অথচ ঘরে একখানা টিভি থাকা চাই ! অর্থাৎ আজ আমরা বৃহত্তর সমাজ আদর্শহীনতায় ভুগছি !
(চলবে)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন